বিভাষ বাড়ৈ ॥ আবার আলোচনায় ডানপন্থী মানবাধিকার বিষয়ক বিতর্কিত সংস্থা ‘অধিকার’। নেই এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন, তবু এনজিওর সুবিধা কাজে লাগিয়ে আসন্ন নির্বাচন ইস্যুতে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী নানা অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে মিথ্যা হত্যার রিপোর্ট দিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া সংস্থাটি। তথ্য প্রমাণ ছাড়া বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে ভুল তথ্য প্রদান করছে বলে সরকারকে সতর্ক করেছে প্রভাবশালী একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থার রিপোর্ট, নির্বাচন কমিশন, দুদক ও এনজিও ব্যুরোর একাধিক চিঠিতে উঠে এসেছে অধিকারের অস্বচ্ছ তৎপরতার নানা চিত্র।
এদিকে এনজিও ব্যুরারে জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিপত্র লঙ্ঘন, ১০ একাউন্টে সন্দেহজনক অর্থনৈতিক লেনদেন, প্রকল্প শেষ হওয়ায় ফান্ড বন্ধ থাকলেও দাতাসংস্থার নগদ অর্থ গ্রহণসহ বিতর্কিত তৎপরতার কারণে অবিলম্বে অধিকারের সব কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এই মুহূর্তে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর কোন নিবন্ধনই নেই অধিকারের। ফলে বিধান অনুসারেই নির্বাচনে স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করেছে ইসি। এনজিও বিষয়ক ব্যুরো নির্বাচন কমিশনে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, ‘নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ১১৯ সংস্থার একটি তালিকা ব্যুরোতে পাওয়া গেছে। ব্যুরোর নিবন্ধিত ৭৫ এনজিওর মধ্যে ‘অধিকার’ সংস্থাটির নিবন্ধনের মেয়াদ ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ শেষ হয়েছে।
সে সময়ের সংস্থার চলমান ১০ প্রকল্পের অডিট রিপোর্টের মধ্যে ৮টির অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হওয়া এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের লেখা পত্রের নিষ্পত্তি না হওয়া এবং সংস্থার প্রকল্পসমূহের আর্থিক লেনদেনে অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হওয়ায় নিবন্ধন নবায়ন করা হয়নি। এছাড়া এ সংস্থা বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেরও পর্যবেক্ষণ রয়েছে মর্মে নথিতে প্রতীয়মান হচ্ছে।’
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অফিস গুলশানে। প্রতিষ্ঠানটি ’৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এক গোয়েন্দ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অধিকার এনজিওটি মূলত মানবাধিকারের প্রত্যয় নিয়ে ২৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও বারা বার দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটি যাদের হাতে গোড়াপত্তন তাদের বাদ দিয়ে বর্তমান সাধারণ স¤পাদক আদিলুর রহমান খান পার্থ কর্তৃক দায়িত্ব নেয়ার পর একের পর এক বিতর্কিত কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে।’ অধিকারের বর্তমান কার্যনিবাহী কমিটি চলছে মূলত আদিলুর রহমান খান পার্থের নামেই। বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটিতে সভাপতি হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সিআর আবরার (চৌধুরী রফিকুল আবরার), কোষাধ্যক্ষ হচ্ছেন সুপ্রীমকোর্টের এ্যাডভোকেট রুহুল আমিন ভূঁইয়া, সদস্য নারী উন্নয়নকর্মী ফরিদা আক্তার ও জে. হাসান।
অধিকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার যোগাযোগ অব্যাহত আছে থাইল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরএল), ফিলিপিন্সভিত্তিক এশিয়ান ফেডারেশন এগেনস্ট ইনভলান্টারি ডিজএপিয়ারেন্স (এএফএডি), থাইল্যান্ডভিত্তিক ফোরাম এশিয়া, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইসিজে ও এফআইডিএইচ এবং ওএমসিটি।
অধিকারের নতুন তৎপরতা ॥ এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, হেফাজতের ঢাকা অবরোধে, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ এবং তাদের শাপলা চত্বর থেকে পুলিশী অভিযানের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে অধিকার বিকৃত ও অসত্য তথ্যে ভরপুর ছিল।
৬১ জন নিহত হওয়ার রিপোর্ট দিলেও তাদের যে তালিকা গোয়েন্দা সংস্থা উদ্ধার করে তার মধ্যে অনেকেই হেফাজতের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণই করেনি, কেউ অন্য জায়গায় অন্যভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। তালিকায় মৃত হিসেবে দেখানো চাঁদপুরের এক মাদ্রাসাছাত্র দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন’ এই উদ্ভট মিথ্যাচারের তালিকা আবার বিশ্বের কয়েকটি দেশের মানবাধিকার সংস্থার কাছে পাঠায় সংস্থাটি।
সংগঠনটি দেশের নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সবসময় আন্তর্জাতিক মহলকে ভুল তথ্য দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি প্রতিনিয়ত নষ্ট করছে বলে অভিযোগ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি থাইল্যান্ডভিত্তিক সংগঠন এএনএফআরএলের ওয়েবসাইটে দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদানসহ কলাম লিখেছেন আদিলুর রহমান খান, যা আন্তর্জাতিক সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে অধিকারের সেক্রেটারি যেসব মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন তার মধ্যে আছে- ’১৪ সালে বিতর্কিত সংসদীয় নির্বাচনের পর বর্তমান সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক সরকারের অনুপস্থিতি দেখা যায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আগামী সংসদ নির্বাচনে সবার জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরি না করে বরং বিরাধেী দলগুলোকে শোষণ ও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ এবং একত্রিত হতে বাধা দিচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, বিদেশী সংস্থার কাছে অধিকারের প্রকাশিত রিপোর্টটি বিরোধেী দল বিশেষ করে বিএনপির পক্ষে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক অপপ্রচারের মাধ্যম হিসেবে এবং বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হচ্ছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া এনজিও বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিপত্র অমান্য করেও সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যদিও উক্ত সংস্থাটির কোন প্রকল্প বর্তমানে চলমান নেই।
অবিলম্বে অধিকারের সব কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, অধিকার নামক এনজিওটি বর্তমানে বাংলদেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে সরকারের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করছে। তাছাড়া সংস্থাটি এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী পরিচালিত না হওয়ায় উক্ত এনজিওটির কর্মকা- সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে।
বর্তমানে এনজিওটির সব অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রম পুরোদমে চালু রয়েছে। এক্ষেত্রে এনজিওটির ব্যয়ভার বহন কিভাবে হয় সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। গোপন সূত্রে জানা গেছে, তারা বিভিন্ন দাতাসংস্থা থেকে নগদ টাকা নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ অবস্থায় এনজিওটির নিবন্ধন বাতিল করে অবিলম্বে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করা যেতে পারে।
এদিকে বিদেশে মিথ্যা তথ্য দেয়াসহ নানা অভিযোগ বিষয়ে কয়েক দফা কথা বলার চেষ্টা করেও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সন্তোষজনক জবাব পাওয়া সম্ভব হয়নি। সংস্থা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সিআর আবরারের কাছে অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না। আমি বিদেশে ছিলাম। এ বিষয়ে আদিলুর রহমানরা বলবে। আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ এরপর সেক্রেটারি আদিলুর রহমানের সেলফোনে কল করে পরিচয় দেয়া হলে অপর প্রাপ্ত থেকে কথা বলার জন্য একটি টিএনটি নম্বর দেয়া হয়। ওই নম্বরে কয়েক দফা কল করা হলেও কেউ তা রিসিভ করেননি।