স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশে স্কুল-কলেজের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছে। মনযোগ দিয়েছে পাঠে। আবার আগের মতোই ক্লাসে ফিরেছে। এমন ঘটনায় আন্দোলন জিইয়ে রাখার পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে সরকারবিরোধী বিএনপি-জামায়াত-শিবির-জঙ্গী, বামপন্থী একটি গ্রুপ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের একটি অংশের। তারা পরিকল্পিতভাবে
দেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রবিবার মাঠে নামে। তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগ কাঁটাবন হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে যায়। এদিকে রবিবার শিক্ষার্থী পরিচয়ে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নেমে আচমকা হামলা চালানো হয়। বহু দোকানপাট ভাংচুর করা হয়। হামলায় আহত হয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের ফটোসাংবাদিক ইবনুল আসেফ জাওয়াদসহ অন্তত পাঁচ সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও পথচারীসহ অন্তত অর্ধশত মানুষ। সরকারবিরোধী আন্দোলন-কারীদের পরিচয়ে ঢাকার কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গে হামলকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভের অষ্টম দিনেও সারাদেশে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে।
রবিবার সকাল থেকেই ঢাকার অধিকাংশ রাস্তা ছিল ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তায় ছিল না কোন আন্দোলনকারী। তবে যানবাহনের চলাচলও কম ছিল। স্কুল-কলেজের কোন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ঢাকার অধিকাংশ রাস্তায় দেখা যায়নি।
দুপুর পৌনে বারোটার দিকে শ্যামলী টেকনিক্যাল মোড় থেকে একটি প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে কয়েক শ’ মানুষকে মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনে দিয়ে মিরপুর-১, সনি সিনেমা হল, স্টেডিয়াম ও মিরপুর-১০ নম্বরসহ আশপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ করতে দেখা গেছে। পরে তারা এসব এলাকার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। তারা বলছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ আন্দোলনকারীদের আড়ালে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার না হন, এজন্যই তারা রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। মানুষের যানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এমন ব্যবস্থা।
এছাড়া শ্যামলী স্কয়ার, আদাবর লিঙ্ক রোড, শিশুমেলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে অন্যান্য দিনের মতো কোন ঝামেলা ছিল না। কোন আন্দোলনকারীকেও এসব জায়গায় দেখা যায়নি।
দুপুর আড়াইটার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের উল্টো দিকে নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজের সামনে বেসরকারী ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০/১২ শিক্ষার্থীকে রাস্তায় দেখা যায়। তাদের গলায় পরিচয়পত্র ঝুলছিল।
এদের মধ্যে ৫ জন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বিভিন্ন যানবাহনকে নির্দিষ্ট লেন মেনে চলার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে দু’একজন ড্রাইভিং লাইসেন্সও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। আর ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বাকিরা। তারা মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য ছোট যানবাহনকে নির্ধারিত লেনে চলার জন্য নির্দেশ করছিল। ফুটপাথ লাগোয়া ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। তাদের গলায় পরিচয়পত্র ছিল। তারা রাস্তায় থাকা শিক্ষার্থীদের চলে আসার জন্য ডাকছিল। সেখানে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে সেখানে কোন ছাত্রীকে দেখা যায়নি। অদূরে পুলিশ অবস্থান করছিল। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, আমরা দূরে থেকে তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছি। কোন অপ্রীতিকর কিছু হওয়ার আভাস পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অন্যদিকে দুপুর দুইটার দিকে সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে একদল তরুণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। তারা যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার নামে মানুষের সঙ্গে চরম খারাপ ব্যবহার করা শুরু করে। একপর্যায়ে তারা যানবাহনে ভাংচুর চালানোর চেষ্টা করে। তবে তাদের গলায় কোন পরিচয়পত্র ছিল না। তাদের পরনে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাকও দেখা যায়নি।
একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের একটি গ্রুপ ও বামপন্থীদের একটি গ্রুপ মিলিত হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী পরিচয়ে মিছিল বের করে। মিছিলটি এর আগে শাহবাগে অবস্থান নেয়া একটি গ্রুপের সঙ্গে মিশে যায়। শাহবাগে আগ থেকেই ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা ছদ্মবেশে অবস্থান নিয়ে ছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে। এরপর সম্মিলিতভাবে মিছিলটি শাহবাগ-কাঁটাবন হয়ে সাইন্স ল্যাবরেটরির দিকে যেতে থাকে। এ সময় তাদের ছবি তুলতে গেলে তাদের মারধরের শিকার হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক।
পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে যায়। পুলিশের ধাওয়ার মুখে বিক্ষোভকারীরা এলিফ্যান্ট রোডে বাটা সিগন্যালের মোড়ের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে। গলি থেকে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারী, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণী পেশার অন্তত ২০ জন আহত হন।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই মিছিলকারীরা সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে যায়। সেখানে মিছিলকারীরা ব্যাপক তান্ডব শুরু করে। তারা রাস্তার মাঝখানে স্টিল দিয়ে করা ডিভাইডারের গ্রিল উপড়ে ফেলে। নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য লাগানো সব গাছের ডাল ভেঙ্গে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে আশপাশে থাকা সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা বন্ধ দোকানপাটে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হন।
এরপর মিছিলকারীরা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলার জন্য পিলখানা-জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড হয়ে রওনা হয়। পুলিশ এ সময় তাদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানায়। পুলিশ তাদের পরিচয় জানতে চাইলে মিছিলকারীরা নিজেদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে দাবি করে।
মিছিলকারীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ধানমন্ডি ৩/এ সড়কে অবস্থিত আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এ সময় বাধা দিলে শিক্ষার্থীদের একাংশ সেখান থেকে ঘুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে রওনা হয়। আরেকটি গ্রুপ আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সময় মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে অন্তত দশ জন আহত হন। তাদের অনেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।