ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

গবেষণা প্রতিবেদন

মাদ্রাসা শিক্ষায় বছরে ব্যয় ১২ হাজার কোটি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

মাদ্রাসা শিক্ষায় বছরে ব্যয় ১২ হাজার কোটি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে প্রতি তিন জন ছাত্রের মধ্যে একজন মাদ্রাসা ছাত্র। বর্তমানে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে তিন দশমিক সাত শতাংশ আর মাদ্রাসায় তিন দশমিক নয় শতাংশ। ২০০৮ সালে সারাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল এক কোটি। এই এক কোটির অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫২ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদ্রাসার। যেখানে কোন প্রকার নিয়ম নীতি আর সরকারের হস্তক্ষেপ নেই। মাদ্রাসা শিক্ষকের সংখ্যাও শিক্ষার্থীদের সংখ্যার অনুপাতের মতোই। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বনাম শিক্ষা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শীর্ষক আলোচনা সভা হয়। এ সময় এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিক উজ জামান, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। সূচনা বক্তব্য দেন এএলআরডি এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার কর্মী ও নিজেরা করি- এর সমন্বয়কারী খুশী কবির। প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন এমন আলোচনা শুরু হয় ২০০৪ সালে। কি ধরনের গবেষণা হবে তার প্রাথমিক ধারণাপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত হয় ২০০৬ সালে। ২০০৭-০৮-০৯ সালে সারা দেশ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি বিচার বিশ্লেষণ ও রাজনেতিক ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করা হয়। ২০১১ সালে এসে বই টি ইংরেজীতে প্রকাশ করা হয়। আর বাংলায় করা হলো এ বছর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে দেখো গেছে মাদ্রাসা শিক্ষায় বছরে ব্যয় আট হাজার কোটি। বর্তমান সময়ে তা বেড়ে অন্তত ১২ হাজার কোটি তো হবে। মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদে যারা আছেন তাদের রাজনৈতির সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাত শতাংশের কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় নি। সরাসরি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামায়াত ইসলামী, ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন ও খেলাফাতে মজলিস মিলে ৫০ শতাংশ, বিএনপি ২৯ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ ২০ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে। বছরে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধির হার তিন শতাংশ। আর মাদ্রাসার বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মাদ্রাসার মধ্যে আলিয়ার চেয়ে কওমির বৃদ্ধির হার বেশি। অন্যদিকে, মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনা পর্ষদে যারা আছেন তারা তাদের ৯২ শতাংশের ছেলে মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়ান না। ৯২ ভাগ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মাদ্রাসায় পড়েন। কিছু নিম্ন মধ্যবিত্ত আছেন যারা তাদের সবচেয়ে কম মেধাবী সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ান। মাদ্রাসায় শিক্ষায় শিক্ষিতদের ৭৫ শতাংশ বেকার। এ বিষয়ে ড. আবুল বারকাত বলেন, এই বেকারদের হাতে যদি কোন কিছু তুলে দিয়ে বলা হয়, ইসলামী রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্য, তাহলে তাদের নামানো সহজ হবে। মাদ্রাসাা শিক্ষা পশ্চাৎপদ। এতে কোন সংশয়, দ্বিধার কারণ নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক মন মননের মানস কাঠামো বিনির্মাণে এই শিক্ষা ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, জঙ্গী উৎপাদন এবং পুনঃ উৎপাদকের ক্ষেত্রে এই শিক্ষা বেশ উর্বর ভূমিকা পালন করে। তিনি আরও বলেন, ‘২০৫০ সাল নাগাদ দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এবং সাধারণ শিক্ষায় কি হতে পারে তার একটি ধারণা তুলে ধরেছি। এতে দুই রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। তাতে বেশ ভীতি সঞ্চার হওয়ার কারণ আছে। ড. শফিক উজ জামান বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ নয়। যারা মাদ্রাসায় গেছেন তারা বাধ্য হয়ে গেছেন। এর জন্য দায়ী আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। আমরা দেশটাকে বিভক্ত করে রাখতে চাই। তাই বলব, নিষিদ্ধ না করে এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। ড. গোলাম রহমান বলেন, এই ধরনের গবেষণার প্রয়োজনীয়তা আমাদের সমাজে অনেক বেশি। আমার মনে হয়, আমরা কখনও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূল স্রোতধারায় আনার চিন্তা করিনি। আমরা যদি মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে নিশ্চয়ই সেই শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হতে পারত। যদি আমরা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার কথাও বলি সেখানে কিন্তু প্রশ্নের শেষ নেই। যে ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, বলতে হবে আদর্শিক দিক দিয়েও এখন আর কার্যকর নেই । আমার লক্ষ্য করছি সাধারণ শিক্ষায় মান থাকছে না। সাধারণ শিক্ষার যে অবস্থা তাতে মাদ্রাসার বিষয় তো সূদূরপরাহত। ড. মেজবাহ কামাল বলেন, জামায়াতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদীর এক ছেলে বলেছেন, মওদুদী তার কোন সন্তানকেই মাদ্রাসায় পড়ান নি এবং জামায়াত ইসলামে সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন নি। এছাড়া মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের ৯২ শতাংশ যে তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ান না, এই যে আত্মপ্রচারণা এটা স্পষ্ট বিষয়। মাদ্রাসার এই ছাত্রদের কিন্তু শিক্ষার অধিকার আছে। এ দেশের সন্তান হিসেবে প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের সর্বাত্মক অধিকার আছে। সে যেন সুশিক্ষা পায়। যথাযথ শিক্ষা পায়। সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটা রাষ্ট্র করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এম এম আকাশ বলেন, এই জরিপে যে তথ্য উঠে এসে তা আমাদের জন্য কিছু বিপদজ্জনক আশঙ্কার দিক নির্দেশনা করে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের হাত তুলে ধরে ধর্মবাজার রেখে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেন তিনি। খুশী কবির বলেন, যখন দেখলাম যে কওমি মাদ্রাসার হার বেড়ে যাচ্ছে তখন মাদ্রাসা নিয়ে আমাদের এই চিন্তা আসে। যেসব সমস্যা আমরা পেয়েছি এর সমাধান হচ্ছে রাজনৈতিক সমাধান। আসুন আমরা সকলে মিলে কিভাবে এই সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কি করা যেতে পারে সেই চিন্তা করি। বই লিখে আলোচনা করে এককভাবে সমাধান আসবে না। ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইটি লিখেছেন-অধ্যাপক আবুল বারকাত, রওশন আরা, এম তাহের উদ্দিন, ফরিদ এম জাহিদ ও মোহাম্মদ বদিউজ্জামান। ভাষান্তর করেন সেলিম রেজা ও সাজেদা রেহানা।
×