এমএ রকিব ॥ কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় কৃষিপণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে এক নবদিগন্ত। কৃষি বিপণন অধিদফতরের আওতাধীন ‘মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প’ এসব অঞ্চলে কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় কৃষকদের এখন আর খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও কাদা-পানিতে কষ্ট করে পণ্য বেচাকেনা করতে হয় না। তারা এখন উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য পাকা এ্যাসেম্বল সেন্টারে বসে বেচাকেনা করতে পারছে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, শস্যগুদাম মডেল সম্প্রসারণের মাধ্যমে চাষীদের ব্যাংক ঋণ সুবিধাসহ অভাব তাড়িত বিক্রি কমানো এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিপণনে দক্ষতা উন্নয়ন ও বিপণন ব্যয় হ্রাস করণের লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটির কর্যক্রম শুরু হয় জুলাই/২০১১ থেকে। প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ৮টি এ্যাসেম্বল সেন্টার ও ২টি নতুন শস্যগুদাম নির্মাণ এবং উৎপাদিত পণ্যের সটিং, গ্রেডিং ও প্যাকেজিং বিষয়ে কৃষকদের দেয়া হয় হাতে কলমে প্রশিক্ষণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকার কৃষকদের সঙ্গে বাজারের সংযোগ স্থাপন এবং বিপণন সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তার লক্ষ্যে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, ও মেহেরপুর জেলায় নির্মাণ করা হয় ৮টি এ্যাসেম্বল সেন্টার। এর মধ্যে ঝিনাইদহে ৩টি, কুষ্টিয়ায় ২টি, চুয়াডাঙ্গায় ২টি এবং মেহেরপুরে ১টি। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য এসব এ্যাসেম্বল সেন্টারে এনে ক্রয়-বিক্রয় করে লাভবান হচ্ছে। এ্যাসেম্বল সেন্টার নির্মাণের ফলে এলাকার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এখন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন এই মার্কেটে এসে দূরদূরান্ত থেকে আগত ব্যাপারীদের কাছে পচনশীল কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে পারছে। ফলে কৃষকদের এখন আর আগের মতো খোলা আকাশের নিচে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে হয় না। এখানে পচনশীল কৃষিপণ্য সর্টিং, গ্রেডিং, পরিচ্ছন্নকরণের জন্য রয়েছে পানির ব্যবস্থা। এতে কৃষি পণ্যের মূল্য সংযোজনসহ পণ্যের সঠিক মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া এ্যাসেম্বল সেন্টারগুলো রফতানির জন্য পান সর্টিং, গ্রেডিং, প্যাকেজিং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প কৃষি বিপণন অধিদফতর কুষ্টিয়ার সহকারী পরিচালক মীর এনামুল ইসলাম জানান, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এই মার্কেটগুলোতে রয়েছে শাকসবজি-ফলমূল রফতানির জন্য কৃষিপণ্যের সর্টিং, গ্রেডিং ও পরিচ্ছন্নতার সুব্যবস্থা। রয়েছে কৃষকদের রোদ, বৃষ্টি, ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়া এবং সবজি ধোয়ার ওয়াশিং বেসিনসহ পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থাও। তিনি জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-মেয়রকে সভাপতি এবং জেলা বাজার কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে গঠিত ৮ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি এ্যাসেম্বল সেন্টার পরিচালনা ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে। সূত্র মতে, প্রকল্পের আওতায় শস্যগুদাম মডেল সম্প্রসারণ এবং কৃষকদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অভাবতাড়িত বিক্রি কমানোর উদ্দেশ্যে ঝিনাইদহ জেলার গাড়াগঞ্জ ও ডাকবাংলা বাজারে দুটি নতুন শস্যগুদাম চালু করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটির ধারণক্ষমতা ২৫০ মেট্রিক টন বা আড়াই হাজার কুইন্টাল। প্রতি কুইন্টাল ১০ টাকা মাসিক ভাড়ায় কৃষকরা এখানে তাদের পণ্য রাখতে পারছে। মৌসুমে ফসলের দাম কম থাকায় চাষীরা তাদের উদ্বৃত্ত পণ্য এই গুদামে জমা রেখে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং পরবর্তীতে দাম বৃদ্ধি পেলে ওই পণ্য বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গায় নির্মিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাম-অফিসে পণ্য বিপণনসহ উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, সর্টিং, গ্রেডিং ও প্যাকেজিং বিষয়ে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প কৃষি বিপণন অধিদফতর কুষ্টিয়ার উপপ্রকল্প পরিচালক দেওয়ান আসরাফুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষি বিপণন অধিদফতরের কার্যক্রম বাস্তবায়নের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, কৃষি পণ্যের বিপণন ব্যবস্থায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং এসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটিয়ে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে পণ্যের সর্টিং, গ্রেডিং, প্যাকেজিং ও অন্যান্য বিপণন বিষয়ে কৃষকদের দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিপণন ব্যয় হ্রাস করে চাষীরা লাভবান হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদকালে কৃষক, কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী-প্রক্রিয়াজাতকারী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তিনি জানান, চার জেলায় ৬ বছর মেয়াদে এই প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ হচ্ছে জুন/২০১৭ সালে। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌর এ্যাসেম্বল সেন্টার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আলমডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র হাসান কাদির গনু বলেন, এ্যাসেম্বল সেন্টারে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভাল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। এর আগে রোদ, বৃষ্টি, কাদা-পানির মধ্যে তাদের সবজি বেচাকেনা করতে হতো। কিন্তু এখন আর চাষীদের সেই কষ্ট নেই। এ্যাসেম্বল সেন্টারে পণ্য ক্রয়-বিক্রির ফলে কৃষকরা ভাল মূল্যও পাচ্ছে। কুষ্টিয়ার মনোহরদিয়া ইউনিয়নের বলরামপুর গ্রামের পানচাষী রফিকুল বলেন, তিনি ২০-২৫ বছর ধরে পান উৎপাদন ও ব্যবসা করছেন। এর আগে তাদের খোলা মাঠে কাদা-পানির মধ্যে পান বিক্রি করতে হতো। কিন্তু এখন আর তাদের সেই কষ্ট নেই। এ্যাসেম্বল সেন্টারে পানের ন্যায্যমূল্য পেয়েও খুশি ব্যবসায়ীরা।