ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস;###;পাকিস্তানীদের গণহত্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ॥ প্রধানমন্ত্রী

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১২ মার্চ ২০১৭

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস

সংসদ রিপোর্টার ॥ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকাণ্ডের দিনটি জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। শনিবার জাতীয় সংসদে জাসদের সাধারণ সম্পাদক বেগম শিরীন আখতারের আনীত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করার প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রস্তাবটি সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানীদের গণহত্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পাকিস্তানী হানাদাররা যে গণহত্যা চালিয়েছে তার কোন প্রমাণ লাগে না। এই গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যতটা দায়ী, ততটাই দায়ী তাদের দোসর যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসরা। আর যারা যুদ্ধাপরাধীদের হাতে লাখো শহীদের রক্তস্তাত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে তারাও দায়ী কম নয়। যারা একাত্তরের গণহত্যার কথা ভুলে যায় তাদের বাংলাদেশের মাটিতে থাকার কোন অধিকার নেই। আর যারা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত। কারণ এরা থাকলেই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হবে, স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। ভবিষ্যতে আর কোনদিন এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে সেটাই আমরা চাই। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১৪৭ বিধি অনুযায়ী আনীত প্রস্তাবটির ওপর বিকেল তিনটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ৬ ঘণ্টার আলোচনায় সরকার, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ৫৪ জন সংসদ সদস্য বক্তব্য রাখেন। সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, বিমানমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সরকারী দলের শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অধ্যাপক আলী আশরাফ, ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ খ ম মোজাম্মেল হক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, সাবেক ডেপুটি স্পীকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী, আবদুল মান্নান, ডাঃ দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবদুল মতিন খসরু, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, খাদ্য প্রতিমন্ত্রী নুুরুজ্জামান আহমেদ, এবি তাজুল ইসলাম, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, কামাল আহমেদ মজুমদার, মনিরুল ইসলাম, ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি, বজলুল হক হারুন, নুরুল ইসলাম সুজন, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম ওয়াহাহাব, সাগুফতা ইয়াসমীন, নুর জাহান বেগম, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, কাজী রোজী, হাজেরা সুলতান, পঞ্চানন বিশ্বাস, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভা-ারী, বিএনএফের চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহজীব সিদ্দিকী, আবদুল মতিন, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর প্রমুখ। আলোচনা শেষে স্পীকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে সরকার ও বিরোধী দলের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। আলোচনাকালে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস, ২৫ মার্চ সরকারী ছুটি ও সিমলা চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে পাকিস্তানী ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার, হানাদারদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের সম্পত্তি বাজেয়াফত এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সকল প্রতিষ্ঠান সরকারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান। আলোচনার শুরুতে সংসদ নেতা শেখ হাসিনার প্রস্তাবক্রমে একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে সংঘটিত পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী কর্তৃক নারকীয় গণহত্যাকা- তৈরিকৃত প্রমাণ্য ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, ভয়াল গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-, ২৫ মার্চ গণহত্যা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের গণহত্যা নিয়ে বক্তব্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও ইপিআরে গণহত্যার চিত্র স্থান পায়। এই প্রমাণচিত্র প্রদর্শনের সময়ে পুরো সংসদ অধিবেশনে ছিল পিনপতন নীরবতা। পাকিস্তানের ভয়াল-বিভীষিকাময় গণহত্যার প্রমাণ চিত্র দেখে অনেকে আবেগাপ্লু হয়ে পড়েন। আলোচনার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পীকারের অনুমতি নিয়ে বলেন, সংসদ সদস্য শিরীন আখতার তার নোটিসের সঙ্গে বেশ কিছু স্থির ও ভিডিও চিত্র দিয়েছেন। তিনি বলেন, ২৫ মার্চের পথ ধরেই এদেশে গণহত্যা শুরু হয়। আমাদের এ পার্লামেন্টে অনেক এমপি আছেন যারা ওই সময়ের ভয়াবহ চিত্র দেখেননি। আমার কাছে ২৫ মার্চের আরও কিছু স্থির ও ভিডিও চিত্র রয়েছে। আপনার অনুমতি পেলে সেগুলো দেখাতে চাই। তাহলে এ নিয়ে আলোচনার আগে ওইসব এমপি অনেক কিছু জানতে পারবেন। এরপরই অধিবেশন কক্ষে থাকা কয়েকটি প্রজেক্টরে প্রায় ১৫ মিনিটের সেই প্রমাণ্য চিত্র দেখানো হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী বলেন, হানাদারা পাকিস্তান থেকে এসেছিল। কিন্তু গণহত্যা চালাতে এদের পথ চিনিয়েছে তাদের দোসর আলবদর-রাজাকার-আলশামসরা। বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে গণহত্যার চিহ্ন না আছে। কিশোরগঞ্জের একটি গ্রাম সোহাগপুর, স্বাধীনতার পরে যার নাম হয়েছিল বিধবা পল্লী। গ্রামটির সকল পুরুষকে হত্যা করেছে পাক হানাদাররা। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত পাক হানাদাররা এদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। তিনি বলেন, যারা একাত্তরে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে, লাখো মা-বোনদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে- সেই পাকিস্তান এখনও বিশ্বব্যাপী আমাদের বিরুদ্ধে বদনাম দিয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের গণহত্যার বীভৎস্য রূপ যারা দেখেছে তারা এই ভয়াবহতা কোনদিন ভুলতে পারবে না। আমরা চাই এ ধরনের গণহত্যা আর কোথাও যাতে না হয়। হানাদাররা ২৫ মার্চ যে গণহত্যা শুরু করেছিল, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের ঠিক আগে নির্বিচারে বুদ্ধিজীবীদের তারা হত্যা করেছিল। যাতে বাংলাদেশ চালাতে কোন জ্ঞানী লোক না থাকে। ২৫ মার্চ গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেনোসাইড বা গণহত্যার সংজ্ঞাই হচ্ছে- সুচিন্তিতভাবে বিশাল সংখ্যক মানুষ কিংবা জাতিকে হত্যা করাই হচ্ছে গণহত্যা। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সেদিক থেকে আমাদের সুযোগ রয়েছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আমরা গ্রহণ করতে পারি। আর পাকিস্তানী হানাদাররা যে গণহত্যা চালিয়েছে তার কোন প্রমাণ লাগে না। তারা ২৫ মার্চ ট্যাঙ্ক, কামানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে পাক হানাদাররা। কীভাবে পাকিস্তানীরা এদেশে গণহত্যা চালিয়েছে তা বিশ্বের সকল গণমাধ্যমেই ওই সময় বেরিয়েছে। কীভাবে তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, লাখ লাখ মা-বোনকে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপপ্রচারের সমালোচনা করে সংসদ নেতা বলেন, দেশের কিছু কুলাঙ্গার আছে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে। পরাজিত পাকিস্তানীদের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনও তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশের কিছু দালাল-কুলাঙ্গার আছে তারাও বিতর্ক তৈরি করে। অবসরে যাওয়ার আগে যাকে আমি বিগ্রেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেলে পদোন্নতি দিয়েছিলাম, সেই জেড এ খান তার বইতে লিখেছে- মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর চক্রান্তের ফসল। দেশের স্বাধীন না হলে এই ব্যক্তিটি কোনদিন মেজর জেনারেল হতে পারতেন না। দেশের এ ধরনের কিছু কুলাঙ্গার যারা পরাজিত পাকিস্তানের লাথি-ঝাঁটা খেয়েও তাদের পদলেহন করে। এদের কারণেই বাঙালী জাতিকে বার বার ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, এতো বড় গণহত্যা, ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। এটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারীদের এদেশে থাকার কোন অধিকার নেই। প্রস্তাব উত্থাপনকারী জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার ঘটনা ঐ সময় কালের হলেও সাম্প্রতিককালে গণহত্যার বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবার লক্ষ্যে সংসদে এবং সংসদের বাইরে ব্যাপক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাই এ বিষয়টি নিয়ে আসন্ন মার্চ মাসের প্রথম সুযোগে সংসদে আলোচনা করে প্রস্তাব আকারে তা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া কোন খেলনা নয়। আন্দোলন সংগ্রামের ধারায় এ দেশের জন্ম। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, আজকের সুসভ্য বিশ্ব সমাজ ও বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত একটি দিন গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। জনগণেরও আজ তা অন্তরের দাবি। সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন ॥ পরে সংসদে সমাপনী বক্তব্যে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপপ্রচারের সমালোচনা করে বলেন, যত অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরও উন্নত হচ্ছে। কোন অপশক্তির কাছে আমরা মাথানত করব না। পাকিস্তানীরা এখনও অপপ্রচার চালাচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল ভারতের ষড়যন্ত্র, ‘র’ এর চক্রান্ত। যেদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছে- সেখানে এটি কীভাবে সম্ভব? মুক্তিযুদ্ধে ভারতসহ মিত্র দেশগুলোর সহযোগিতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংসদ নেতা বলেন, ভারতসহ অনেক দেশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমেরিকাসহ অনেক দেশ পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ালেও সেসব দেশের জনগণও আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনী এদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। এদেশের এক কোটি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। তিনি বলেন, কারও এতটুকু মনুষ্যত্ব থাকলেও যে দেশে গণহত্যা চলে সেদেশের মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে পারে না। বিশ্বের যেসব দেশেই গণহত্যা চলেছে, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হয়েছে- সেসব দেশের পাশেই অনেক মিত্রশক্তি দাঁড়িয়েছে। ভারতসহ অনেক দেশই মিত্রশক্তি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই মিত্রশক্তি থাকাটা কোন অপরাধ নয়। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে সেটাই দোষ। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাত্র তিনমাসের মধ্যে এদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্য প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের যেখানেই কোন দেশ অন্যদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে, সেখানেই মিত্রশক্তি ওই দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। একমাত্র বাংলাদেশই এর ব্যতিক্রম। ভারতই একমাত্র দেশ যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরও এদেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেনি। জাতির পিতার অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী মাত্র তিনমাসের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের গঠনমূলক ভূমিকার প্রশংসা করে সংসদ নেতা বলেন, জাতীয় সংসদে এক সময় থাকার কোন পরিবেশ ছিল না। এখানে কেবল খিস্তি-খেউর হতো। জঘন্য ভাষা ব্যবহার হতো। বিএনপি-জামায়াত যখন এই সংসদে ছিল, তখন তাদের খিস্তি-খেউরে সংসদে থাকা যেত না। সংসদের কার্যবিবরণী টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার হতো। কিন্তু এখানে যে জঘন্য ভাষা ব্যবহার হতো, কোন ভদ্র মানুষের পক্ষে সেটি শোনাও সম্ভব হতো না। এখন সেই খিস্তি-খেউর ও জঘন্য ভাষা নেই। যারা বিরোধী দলে আছেন, তাদের বক্তব্যও গঠনমূলক। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। সংবাদপত্রকর্মীদের জন্য নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ সংবাদপত্রের মালিকই বেসরকারী। বেসরকারী মালিকরা কী করবেন, সেটি তাদের বিষয়। এরপরও আমরা ওয়েজবোর্ড করে দিচ্ছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি। দ্রব্যমূল্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে দাবি করে তিনি বলেন, অভাব যাতে মানুষের না থাকে, তার সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা করেছি। নানা প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে। একটি মানুষও আর দরিদ্র থাকবে না, গৃহহারা থাকবে না। গণহত্যার প্রস্তাব নিয়ে অন্য নেতারা যা বলেন ॥ আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ বলেন, বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তানীরা গণহত্যা চালিয়েছিল। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর কেন নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে? স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা নিয়ে কেন বিতর্ক করা হয়? ২৫ মার্চ অবশ্যই আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, ২৫ মার্চ ভয়াল গণহত্যা দিবস। পাকিস্তানীরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল বাঙালী জাতিকে। আন্তর্জাতিকভাবে নিশ্চয় একদিন এ দিবসটি স্বীকৃতি পাবে। রক্তের সিঁড়ি দিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। রক্তের ঋণ শোধ করা যায় না। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে সেই রাতে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন আর ফিরবেন না, সেজন্য ২৬ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বাঙালী সৈনিকরা যাতে প্রতিরোধ গড়তে না পারে সেজন্য সবাইকে পাকিস্তানে বদলি করা হয়। আমাকে পাকিস্তানে বদলি করায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। এটা আমার জীবনের বড় দুঃখ। বদলির নির্দেশ অমান্য করার কোন সুযোগ ছিল না। সেজন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সুযোগ পেলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সব করব। তাই সরকারে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলাম। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা দিতে পারিনি। আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি গৃহীত হয় প্রধানমন্ত্রী সেই চেষ্টা করবেন। জাতির পিতা আমারও পিতা, সবার পিতা। তিনি সার্বজনিন, কোন দলের একক সম্পত্তি নয়। যার জন্ম না হলে আমি সেনাবাহিনীর প্রধান, রাষ্ট্রপতি হতে পারতাম না। তাঁর ঋণ শোধ করার নয়। দুঃখ আরেকটা আছে, মন্ত্রিপরিষদে প্রস্তাব আনার পরও কয়েকজনের বিরোধিতার কারণে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করতে পারিনি। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানের গণহত্যা ছিল নাৎসী বাহিনী থেকেও ভয়ঙ্কর। শুধু জাতীয়-আন্তর্জাতিকই নয়, খোদ পাকিস্তানের অনেক জেনারেলও স্বীকার করেছে গণহত্যার কথা। ত্রিশ লাখ হত্যার ঘটনা বিশ্বের কোথাও হয়নি। খালেদা জিয়ারা ক্ষমতায় থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের শুধু মন্ত্রী বানানো নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার করত। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস এবং ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, যেহেতু একাত্তরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং এদেশীয় সহযোগীরা বাংলাদেশের ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইন্যুনাল আইন ১৯৭৩-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা। পাকহানাদারদের ২৫ মার্চ নজিরবিহীন গণহত্যা সূচনা করেছে, যা পরবর্তীতে ৯ মাস অব্যাহত ছিল। যেহেতু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গণহত্যার সময় বিভিন্ন নৃশংসতা, হত্যাযজ্ঞ গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাই ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন তিনি। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, একাত্তরে পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়েছে এ বিষয়ের কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই। খালেদা জিয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কারণ উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের আদর-আপ্যায়নের কথা ভুলতে পারেন না। পাকিস্তানের পেয়ার বিএনপি নেত্রী ভুলতে পারেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বার বার বাঙালী জাতিকে রক্ত দিয়ে অধিকার আদায় করতে হয়েছে। এ দেশে মুশতাক ও জিয়ার মতো বিশ্বাসঘাতকের জন্ম হয়েছে। তাই আমরা যে প্রস্তাব নিচ্ছি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতে পারে। একাত্তরের ঘাতক-খুনীদের খালেদা জিয়া সংসদে বসিয়েছেন, রক্ত¯œাত পতাকা দিয়ে দিয়েছেন। এরা পাকিস্তানের দোসর, প্রেমিক। খালেদা জিয়াসহ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিদের চিরতরে অপসারণ করতে হবে। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ২৫ মার্চ কালরাত্রেই পাকিস্তানী বাহিনী প্রায় এক লাখ বাঙালীর ওপর গুলি চালায় বলে ওই সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, পরাজিত অপশক্তি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে। খালেদা জিয়া মনেপ্রাণে পাকিস্তানী, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তিনি অবমাননা করেছেন। এখনও উনি দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি। শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। সিমলা চূক্তি অনুযায়ী তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচারের দাবি জানান। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, পাকিস্তান প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে ২৫ মার্চ গণহত্যা চালিয়েছিল। ১৯৭২ সালের হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেই পাক হানাদারদের গণহত্যার নিষ্ঠুর চিত্র বেরিয়ে এসেছে। ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যার আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি, আর পাকিস্তানীরা প্রতিদিন গণহত্যা চালিয়েছে। বাংলাদেশে এখনও পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা তৎপর। ভবিষ্যতে আর কোনদিন পাকিদের দোসরা ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য সব রাজাকার-আলবদর ও অগ্নিসন্ত্রাসীদের বিচার করতে হবে। ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, সারাবিশ্বই জানে একাত্তরে পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়েছে, ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সঠিকভাবে উদ্যোগ নিলে অবশ্যই ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে যে ভয়াল গণহত্যা চালিয়েছে তা পৃথিবীতে বিরল। নিজামী-মুজাহিদদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন আর জাহানারা ইমামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সংসদ অধিবেশন সমাপ্ত ॥ দশম জাতীয় সংসদের দীর্ঘতম চতুর্দশ অধিবেশন শনিবার শেষ হয়েছে। রাত পৌনে ১১টায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের অধিবেশন সমাপ্তি সম্পর্কিত ঘোষণা পাঠ করেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর মধ্য দিয়ে অধিবেশনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। তার আগে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ অধিবেশনে সমাপনী ভাষণ দেন। দশম জাতীয় সংসদের ১৪তম এই অধিবেশন ২২ জানুয়ারি শুরু হয়। মোট ৩৮টি কার্যদিবসের এ অধিবেশনে আলোচিত বাল্যবিবাহ নিরোধ বিলসহ ১০টি বিল পাস হয়। আইনপ্রণয়ন সম্পর্কিত কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি কার্যপ্রণালি বিধির ৭১ বিধিতে ১৮৫টি নোটিস পাওয়া যায়। নোটিসগুলো থেকে ১২টি গৃহীত হয়। এ ছাড়া ৭১ (ক) বিধিতে দুই মিনিটের আলোচিত নোটিসের সংখ্যা ছিল ৪টি। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য সর্বমোট ২৬১টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি ৯৬টি প্রশ্নের উত্তর দেন। মন্ত্রীদের জন্য আনা ৪ হাজার ২৬০টি প্রশ্নের মধ্যে ৩ হাজার ২১৬টি প্রশ্নের জবাব দেন। স্পীকার সংসদ অধিবেশন পরিচালনায় সহযোগিতা করায় সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, চীফ হুইপসহ হুইপগণ, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সব সংসদ সদস্য, ডেপুটি স্পীকার ও সভাপতিম-লীর সদস্য, মিডিয়ার কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সমাপনী ভাষণের পর স্পীকার দশম জাতীয় সংসদের ১৪তম অধিবেশন সমাপ্তি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ পাঠ করেন।
×