স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ বৃহত্তর বগুড়ার ওয়াকফ এস্টেটগুলো একের পর এক বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ দখলকারী ওয়াকফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী। এর বাইরে এক শ্রেণীর ভূমিগ্রাসী ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো জোর করে দখল করছে। উচ্চ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ওয়াকফ সম্পত্তি বেআইনীভাবে কম দামে কিনেও নিচ্ছে। সরকারকে ফাঁকি দিচ্ছে বহু অঙ্কের টাকার রাজস্ব।
বগুড়া ও জয়পুরহাটে এক হাজার ১শ’ ৮৮টি ওয়াকফ এস্টেট রয়েছে। এই খাতে জমির পরিমাণ অন্তত ৪২ হাজার একর। এর মধ্যে প্রজাবিলি জমির পরিমাণ ৩৫ হাজার একর। অর্থাৎ ওয়াকফকারী যে জমি তাদের ওয়ারিশদের বর্গা বা দান করেছে। বাকি সাত হাজার একর জমি ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে রাখা হয়। এই জমির দুই হাজার একরেরও বেশি বেদখল হয়ে গেছে। ওয়াকফ সম্পত্তির সরকারীভাবে প্রদেয় রাজস্বের অংশের অন্তত ৪০ লাখ টাকা পাওনা পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষের কথা, লোকবলের অভাবে তদারকি করা যায় না। যা তদারকি হয়েছে অনিয়ম পাওয়ার পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকারী নিয়ম উপেক্ষা করে বেচাকেনার বিষয়ে তাদের কোন সদুত্তর নেই। এই ধরনের বেচাকেনায় কোন মামলা হয়েছে কি-না এই বিষয়ে কোন উত্তর মেলেনি। দেশের সকল ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে। দেখভাল করে সরকারের ওয়াকফ প্রশাসন। মাঠপর্যায়ে একজন পরিদর্শকের অধীনে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে চলছে নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম। বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার ওয়াকফ ভূমি দেখভাল করেন একজন পরিদর্শক। সূত্র জানায়, ভূমিগ্রাসী চক্রের সঙ্গে ওয়াকফ প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মচারীর সখ্য রয়েছে। তারাই বলে দেয় কিভাবে কোন ফাঁকফোকর দিয়ে ওয়াকফ সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া যায়। বগুড়া সদরের এরুলিয়া এলাকায় পীর আজিজুল্লাহ (র) মাজার ওয়াকফ এস্টেটের তিনটি পুকুরসহ প্রায় ১৭ বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। দুপচাঁচিয়ার হিরঞ্জা এলাকার দমশের তালুকদার ওয়াকফ এস্টেটের ৬৩ একর ভূমির মধ্যে প্রায় ২৬ একর জমি দখল হয়ছে। অভিযোগ মেলে, যাদের কাছে সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারাই দখল করেছে। এই এস্টেটে সরকারী অংশের প্রদেয় রাজস্ব বকেয়া রয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। সূত্র জানায়, অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই এস্টেটের মোতওয়াল্লীকে বাতিল করে সরকারের প্রতিনিধি (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) দায়িত্ব পেয়েছেন। গাবতলীর গোড়াদহ এলাকায় ছমির উদ্দিন সরকার ওয়াকফ এস্টেটের ৬১ একর সম্পত্তির মধ্যে প্রায় ৪৫ একর বেদখল হয়ে গেছে। এই এস্টেটেও দখলের অভিযোগের আঙ্গুল মোতওয়াল্লীর দিকেই। বগুড়া শহরে বৃন্দাবনপাড়ায় মুন্সি নাসির উদ্দিন ম-ল ওয়াকফ এস্টেটের অর্ধেক ভূমি দখল হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে বগুড়ার নওয়াব এস্টেটের ওয়াকফ ভূমি ও স্থাপনা। এই এস্টেট তদানীন্তন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার পূর্বপুরুষের। বংশানুক্রমে তাদের পরিবারের সদস্য মোতওয়াল্লীর দায়িত্ব পালন করেন। নিকট অতীতের পূর্বপুরুষ সোবাহান চৌধুরী তার স্ত্রী তহুরুন্নেছা থেকে পরবর্তী বংশধররা জমিদারি ও নওয়াবী খেতাবপ্রাপ্ত হওয়ার পর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভোগদখল করতে থাকেন। চতুর্থ বংশের মোহাম্মদ আলী বগুড়া। তার আগের বংশধর বেশকিছু জমি শিক্ষা ও মানবকল্যাণে ওয়াকফ করেন। মোহাম্মদ আলী বগুড়া ইন্তেকালের পর বৈমাত্রীয় ভাই ওমর আলী চৌধুরী ও আমীর আলী চৌধুরীর নজর পড়ে ওয়াকফ সম্পত্তির দিকে। শুরু হয় বেচাকেনার পালা। বৈমাত্রীয় দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর মোহাম্মদ আলীর তিন ছেলে ও এক মেয়ে দায়িত্ব পান মোতওয়াল্লীর। ওয়াকফ এস্টেট বেচাকেনার পালার পর তাদের বসতভিটার অংশ বেচাকেনা শুরু হয়। বসতভিটার ধারে যে বিশাল ভূমি ওয়াকফ করা আছে তার সবই নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি হয়েছে। দুজন বিড়ি ব্যবসায়ী, একটি বেসরকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, ঢাকার বড় একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ওয়াকফ ভূমি কিনে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছে। সর্বশেষ একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৫০ শতাংশ ওয়াকফ ভূমি কিনেছে। জনশ্রুতি আছে, এই ভূমির দাম অন্তত ৫০ কোটি টাকা। দলিল হয়েছে ছয় কোটি টাকার। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি বহু অঙ্কের টাকার।
মোহাম্মদ আলী বগুড়ার তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে তাদের বসতভিটার যে অংশটুকু এখনও টিকে আছে তা রক্ষায় সরকারকে অধিগ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। তারা আশা করেন, সম্পত্তির সবই যখন চলে যাচ্ছে তখন শেষ ভূমির এই অংশটুকু প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরকে দেয়া হোক। তারা ঐতিহ্য ধরে রাখবে।
নওয়াবের এই ওয়াকফ সম্পত্তি বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে সামান্য পূর্বে। ওয়াকফ সম্পত্তি বেচাকেনার পালায় বর্তমানে মোহাম্মদ আলী বগুড়ার বাসভবন প্রাচীন কীর্তি হওয়ায় বিক্রিতে বগুড়ার সচেতন মানুষ বাধা দিয়েও কোন লাভ হয়নি। উচ্চ প্রভাবশালীদের হাত এতটাই লম্বা যে, তারা আইনকেও তোয়াক্কা করে না। জয়পুরহাটের ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর মুকিমপুর এলাকার চৌধুরী ওয়াকফ এস্টেটের অর্ধেকেরও বেশি ভূমি দখল হয়ে গেছে। ভূমিদস্যু ও ভূমিগ্রাসী চক্র যেখানেই ওয়াকফ ভূমির খোঁজ পাচ্ছে সেখানেই গ্রাসের জন্য সকল শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের সামনেই দখল করছে।