স্টাফ রিপোর্টার, ঈশ্বরদী ॥ পাবনার ঈশ্বরদীতে ব্যাপ্টিস্ট খ্রীস্টান মিশনের ফাদার লুক সরকারকে (৫২) গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার সকাল নয়টায় বিমানবন্দর রোডের ভাড়া বাসায় ঢুকে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায় তিন দুর্বৃত্ত। মনি মল্লিকের বাসায় ভাড়া থাকেন ফাদার লুক। লুক সরকার ঈশ্বরদীর ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’র ফাদার।
লুক সরকারের স্ত্রী পদ্মা সরকার জানান, তার স্বামী খ্রীস্টান মিশনের ফাদারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসক হিসেবে বাসায় প্র্যাকটিস করতেন। প্রতি দিনের ন্যায় সকালে রুমে বসে বাইবেল পাঠ করছিলেন তিনি। এ সময় তিন যুবক বাসায় এসে ধর্মপাঠ শোনার কথা বলে ড্রইংরুমে বসে। তখন তিনি পাশের রুমে গেলে ওই তিন যুবক ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে তার স্বামীর গলায় ছুরিকাঘাত করতে থাকে। এ সময় তিনি চিৎকার শুরু করেন। চিৎকার শুনে তাৎক্ষণিক তিনি অন্য দরজা দিয়ে ওই রুমে ঢুকলে দুর্বৃত্তরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। বাড়ির কেয়ারটেকার আজগর আলী জানান, দুর্বৃত্তরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তাদের পেছনে ধাওয়া করে একজনকে জাপটে ধরি। পরে অন্য দুজন তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে মোটরসাইকেল রেখেই পালিয়ে যায়। বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড় থাকলেও দুর্বৃত্তদের হাতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র থাকায় তাদের আটক করতে সাহস পায়নি কেউ। ঘটনার পর লুক সরকারকে মুমূর্ষু অবস্থায় প্রথমে ঈশ্বরদী হাসপাতালে ও পরে পাবনা হাসপাতালে ভর্তি করে গলায় সাতটি সেলাই দেয়া হলে তিনি আশঙ্কামুক্ত হন।
আহত লুক সরকার বলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর রফিকুল নামে এক ছেলে ফোন করে বলে, ‘আপনি ধর্ম নিয়ে কাজ করেন। আমি ধর্ম পরিবর্তন করতে চাই। আপনার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে হবে। কখন আসব বলেন।’
তখন লুক সরকার বলেন, ‘কখন আসবে, তোমরা বললে আমি থাকব। সে মোতাবেক ওইদিন দুই যুবক খুব ভদ্রতার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে আলাপ করে চলে যায়। সেই সূত্র ধরে সোমবার সকাল নয়টায় ওই দুই যুবকসহ তিনজন বাসায় আসে। তাদের বসতে বলি। তারা চেয়ারে ও বিছানায় বসে। এমন সময় আমার স্ত্রী নাস্তা আনার জন্য ভেতরে গেলে তারা আমার মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরি চালাতে থাকে। এ সময় আমি হাতে কামর ও ধাক্কা দিলে বারান্দায় চলে যায়। ধস্তাধস্তি ও গুংরানোর শব্দ শুনে আমার স্ত্রী ও মেয়ে এসে চিৎকার শুরু করলে তারা পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদের ধাওয়া করে ধরতে ব্যর্থ হয়। তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয়েছে যুবক তিনটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সদস্য। তা না হলে আমি একজন নিরপরাধ মানুষ, ধর্ম নিয়ে কাজ করি। আমাকে হত্যা করার চেষ্টার যৌক্তিক কোন কারণ পাই না।
বাড়ির মালিক মনিরুল ইসলাম মল্লিক জানান, সোমবার সকাল নয়টার দিকে ভাড়াটিয়া লুক সরকার ড্রইংরুমে পবিত্র বাইবেল পাঠ করছিলেন। এ সময় তিন যুবক লাল রংয়ের এ্যাপাচি মোটরসাইকেলে (ঢাকা মেট্রো-ট ১১-৯০৫৪) করে লুক সরকারের বাসায় আসে। তারা বাসায় ঢুকে ফাদার লুককে জবাই করে হত্যার চেষ্টা করে।
ঈশ্বরদী থানার পুলিশ পরিদর্শক আবু ওবায়েদ জানান, ঢাকা ও রংপুরের বিদেশী হত্যার সঙ্গে লুক হত্যা চেষ্টার কোন মিল নেই। তাছাড়া ওই দুই জায়গায় গুলি করে হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। এখানে চাকু ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ওই যুবকদের সঙ্গে আগেও লুক সরকারের বাড়িতে সাক্ষাত ও কথা হয়েছে। তবে ঘটনা যাই হোক, পুলিশ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে।
ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিমান কুমার দাশ জানান, পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মোটরসাইকেলটি জব্দ করেছে। তবে কাউকে আটক করা যায়নি। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্তও শুরু হয়েছে।
পাবনার পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
ফাদার লুক সরকার সাতক্ষীরার তালা উপজেলার গোনালীপাড়া গ্রামের মৃত মানিক সরকারের ছেলে। ঈশ্বরদীতে গির্জায় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাড়িতে চেম্বার খুলে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন তিনি। তার একমাত্র ছেলে লিটন সরকার ঢাকায় লেখাপড়া করে। মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঈশ্বরদী থাকেন।
তালার খলিলনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রণব ঘোষ বাবলু বলেন, ফাদার লুক সরকার খুবই নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। কোন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই তার। বহু বছর আগে তিনি সাতক্ষীরা থেকে পাবনার ঈশ্বরদীতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।
লুক সরকারের ভাইপো অমল সরকার জানান, মাস তিনেক কাক একবার গ্রামের বাড়ি আসেন। তার কাকার ওপর কেউ হামলা করতে পারে এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। কারণ তিনি খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ।