মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আন্ধার মানিক নদী। এর পশ্চিমে মনোরম এই বনাঞ্চলের অবস্থান। পর্যটকদের জন্য নয়নাভিরাম উপভোগ্য স্পট ফাতড়ার বনাঞ্চল। ইতোমধ্যেই একে নেয়া হয়েছে জাতীয় উদ্যানের আওতায়। বনাঞ্চল এখন দেশের দ্বিতীয় সুন্দরবনের মর্যাদা পেতে চলেছে।
এখানে এলে প্রথমেই চোখে পড়বে অনেক সুন্দর সুন্দর লেক। লেকগুলোর পাশে সবুজের সমারোহ। রয়েছে অসংখ্য গাছ। বনে বানর ছাড়াও আছে মেছো কুমির, বনমোরগ, বাঘদাসা, বুনো শুয়োর, বনবিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী। চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সংরক্ষিত এই বনাঞ্চল দেখতে প্রতিদিন এখানে আসেন বহু পর্যটক। বিশেষ করে কুয়াকাটায় আসা পর্যটক দর্শনার্থীরা ভুল করেন না প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটি দেখতে।
আন্ধার মানিক নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে বিশাল এই বনাঞ্চল। বনের গাছ-গাছালির মধ্যে রয়েছে শাল, সেগুন, ছইলা, কেওড়া, গজারি, হেতাল, গেঁওয়া, সুন্দরী, বাইনসহ গুল্মজাতীয় বহু গাছ। গাছগুলো দেখলে মনে হয় যেন কে কার আগে বেড়ে উঠবে এ নিয়ে তারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বন্য প্রাণীর পারস্পরিক মিতালী চোখে পড়ার মতো। ১২টি দীর্ঘ লেকে ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে এখানে। স্পিডবোট,
ইঞ্জিনচালিত নৌকা কিংবা ট্রলারে ঘুরে বেড়ানো যায়। সন্ধ্যা হলে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে একাকার হয়ে যায় সবকিছু। বনাঞ্চল লাগোয়া সৈকতের বেলাভূমে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ রয়েছে ।
ষাটের দশকে ফাতড়ার বনাঞ্চলটি বন বিভাগ রিজার্ভ ঘোষণা করে। কাগজপত্রে এর নাম ‘টেংরাগিরি’। এখন আর এই নামে কেউ চেনে না। তখন এর আয়তন ছিল ১৯৭৫ দশমিক ০৭ একর। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ বিভাগীয় বন উন্নয়ন অফিসারের তত্ত্বাবধানে চারা রোপণের কাজ শুরু হয়। ’৭৪ সালে ফাতড়ার বনাঞ্চল ঘেঁষে ওঠা নতুন চরে বনায়ন করা হয়। তখন এই এলাকায় সাত হাজার সাতশ’ সাত একর নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা হয়। নেয়া হয় সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা। এ ছাড়া সহস্রাধিক একর জায়গাজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে ছইলা, কেওড়া, গেঁওয়া ও বাইনগাছ জন্মায়। ফাতড়ার বনাঞ্চলের অধিকাংশই প্রাকৃতিক বনভূমি। আগে থেকেই জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। বর্তমানে বন বিভাগের দেয়া তথ্যানুসারে ফাতড়ার বনাঞ্চলের আয়তন নয় হাজার নয় শ’ ৯০ একর। বাস্তবে এর আয়তন আরও বেশি হতে পারে।
বনাঞ্চলটিতে পর্যটকের যাতায়াতের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন করা জরুরী। পর্যটকের কাছে আকৃষ্ট করতে মনোরম লেকগুলোয় যেমন- চরের খাল, ছোট চরের খাল, ফাইসাখালী, বেহুলার খাল, নিশান বাড়িয়ার খাল, নিদ্রা সখিনার খালগুলোয় ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে প্যাডেল বোট চালু করা যেতে পারে। শীতকালে চরগুলোতে যাযাবর হাঁসের ঝাঁক, কাদাখোঁচা ও হাড়গিলাসহ বিভিন্ন পাখি দেখার জন্য ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করাও জরুরী। প্রয়োজন পিকনিক স্পট স্থাপন করা। বনভূমির মধ্যে নির্মাণ করা যায় কটেজ। স্কি ও বোটিং ক্লাবের সম্ভাবনা রয়েছে।
ফাতড়ার চরের আরেকটি আকর্ষণ হলো মৌসুমী বাসিন্দাদের জীপনযাত্রা। এরা শীতের পুরো মৌসুমে সপরিবারে বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ করে। জীবিকার প্রয়োজনে বনাঞ্চলের গাছের সঙ্গে মাচান বেঁধে বানায় অস্থায়ী বসতি। মৎস্য বন্দর মহীপুর ও কুয়াকাটা সৈকত থেকে ট্রলারযোগে ফাতড়ার বনাঞ্চলে যাওয়ার বেসরকারী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। জাতীয় উদ্যানের অধীন ফাতড়ার দক্ষিণ প্রান্তে সৌন্দর্যম-িত স্পট করা হয়েছে। পর্যটকের বসার জন্য বেঞ্চ করা হয়েছে। করা হয়েছে শেড। পর্যটকের বোট ভিড়তে নির্মাণ করা হয়েছে কাঠের ঘাট। নিরাপত্তার জন্য ফরেস্ট গার্ড সর্বক্ষণিক থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। সমুদ্রে লোনা পানি থাকায় পর্যটকের ব্যবহারের জন্য একটি পুকুর খনন করা হয়েছে। যেখানে সারা বছর মিঠা পানি পাওয়া যায়। বিশ্রামের সুযোগ ছাড়াও রয়েছে কাঁকড়াসহ চিংড়ি ফ্রাই খাওয়ার সুযোগ।
বনাঞ্চলে যেতে কুয়াকাটা সৈকত থেকে ট্রলার রয়েছে। শান্ত সমুদ্র পেরিয়ে বনের গহীনে বেড়ানোর সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায়না কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটক। আর পর্যটকের যাওয়াকে কেন্দ্র করে বন বিভাগ পেয়ে থাকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। ট্রলারপ্রতি একেকবারে দু’শ’ টাকা আয় করছে। তবে পর্যটকের আকর্ষণ বাড়াতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো প্রয়োজন। মনোরম বনটির সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে বন উজাড় করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কারণ বনদস্যুর ভয়াল থাবায় নিধন হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে ফাতড়ার বনাঞ্চলের। শীত মৌসুমে এখান থেকে পর্যটক দর্শনার্থীরা উপভোগ শেষে মোহনা পেরিয়ে সাগর দিয়ে ট্রলারযোগে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করতে করতে ফিরে যায় কুয়াকাটা সৈকতের বেলাভূমে।