ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

পৃথিবীর শেষ প্রান্তে কী আছে? জেনে নিন আদ্যোপান্ত

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

পৃথিবীর শেষ প্রান্তে কী আছে? জেনে নিন আদ্যোপান্ত

বিশ্ব মানচিত্রের একেবারে দক্ষিণে, যেখানে পৃথিবী প্রায় শেষ হয়ে আসে,সেই বিস্ময়কর প্রান্তেই ছড়িয়ে রয়েছে এক অনন্য ভূখণ্ড, পাতাগোনিয়া। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র, ইতিহাস, জীববৈচিত্র এবং পর্যটনের জন্যও এটি এক অমূল্য রত্ন। আসুন, এই 'শেষ প্রান্তের' আদ্যোপান্ত জানি।

দুই মহাদেশের এক বিস্ময়:পাতাগোনিয়া

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভূপ্রাকৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ অঞ্চলের নাম 'পাতাগোনিয়া'। একই সাথে পর্বত, উপত্যকা, হিমবাহ, মালভূমি, নদী, হৃদ এবং সমুদ্র উপকূলের সমন্বয়ে গঠিত এই অঞ্চলটি বিচিত্র ভূমিরূপের জন্য সুপরিচিত।

পাতাগোনিয়া কোনো স্বাধীন দেশ নয়। এটি আর্জেন্টিনা ও চিলি এই দুটি দেশের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত একটি বিশাল অঞ্চল। এর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ পড়েছে চিলির মধ্যে, বাকি অংশটি আর্জেন্টিনার। বিস্তৃত ৬৭ লাখ তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাতাগোনিয়ার অবস্থান, যা তিনটি মহাসাগরের সংযোগস্থলে। পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর এবং দক্ষিণে কুমেরু মহাসাগর ও ম্যাজেলান প্রণালী ঘিরে রেখেছে এই অঞ্চলকে।

প্রকৃতির বৈচিত্র্যে ভরা এই অঞ্চল

পাতাগোনিয়া মূলত আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চল থেকে আটলান্টিক সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৫০০০ ফুট। ভূপৃষ্ঠের ধরন অনুযায়ী এটি একটি মরুপ্রায় মালভূমি। এখানে বৃষ্টিপাত খুবই কম, জলবায়ু অত্যন্ত শুষ্ক ও রুক্ষ। তবে কিছু অংশ তুলনামূলকভাবে কম শুষ্ক, যেগুলো 'পাম্পাস' নামে পরিচিত এবং সেখানে ঘাস জন্মে।

আবহাওয়ার অদ্ভুত চরিত্র

দুই পাশে মহাসাগর থাকলেও পাতাগোনিয়ায় বৃষ্টিপাত কম হয়। এর কারণ আন্দিজ পর্বতশ্রেণি, যা পশ্চিম থেকে আসা বৃষ্টিযুক্ত মেঘকে আটকে দেয়। ফলে বৃষ্টির পর অন্য পাশে পৌঁছানো বাতাসে আর জলীয় বাষ্প থাকে না, এবং এলাকাটি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এক শীতল মরুভূমি ও তার সৌন্দর্য

পাতাগোনিয়ার মরু অঞ্চল আর্জেন্টিনার বৃহত্তম ও পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম মরুভূমি। এটি মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির মতো উষ্ণ নয়, বরং একটি শীতল মরুভূমি। তাপমাত্রা গড়ে ৩ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। শীতকালে ভারী তুষারপাত হয়, গ্রীষ্মে চারপাশ ফুলে ভরে ওঠে।

হিমবাহ, হৃদ ও আগ্নেয়ভূমির মেলবন্ধন

পাতাগোনিয়ার পশ্চিম অংশে আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চল আছে, যাকে বলা হয় 'পাতাগোনিয়ান আন্দিজ'। এখানকার হৃদগুলো গড়ে উঠেছে হিমবাহের মধ্য দিয়ে, ফলে অঞ্চলটিতে হিমবাহ-গঠিত ভূপ্রকৃতি দেখা যায়। এছাড়া নিগ্রো নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলে আগ্নেয়শিলা গঠিত ভূমিরূপ বিদ্যমান। এখানকার আগ্নেয় মাটি অত্যন্ত উর্বর।

উদ্ভিদজগতের অভিযোজন ও বৈচিত্র্য

শুষ্ক অঞ্চল হওয়ায় এখানে ক্যাকটাস জাতীয় জেরোফাইটিক উদ্ভিদ দেখা যায়। তাদের খরা সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে এবং তারা প্রাণীদের খাদ্য হতে পারে না বলে টিকে থাকে। তুলনামূলক কম শুষ্ক অঞ্চলে ঘাস জন্মে।

বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য

পাতাগোনিয়ার ভাল পেনিনসুলা ইউনেস্কোর স্বীকৃত একটি জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র। এখানে পুমা, গোয়ানাকো, পাতাগোনিয়ান শিয়াল, বন্য ঘোড়া ছাড়াও আটলান্টিক উপকূলে ডলফিন, তিমি, এলিফ্যান্ট সিল এবং ম্যাজেলান পেঙ্গুইন দেখা যায়। পাখিদের মধ্যে আছে কেরাকেরা, চিলিয়ান ফ্লেমিঙ্গো, অস্ট্রাল প্যারাকিট, ফায়ার গ্রাউন্ড ও আন্দিয়ান কন্ডোর।

ডাইনোসরের খোঁজ এবং ইতিহাসের ধারা

পাতাগোনিয়া কেবল প্রকৃতির নয়, অতীতেরও রত্নভাণ্ডার। এখানে পাওয়া গেছে ডাইনোসরের বৃহত্তম জীবাশ্ম। প্রাচীন অধিবাসী 'তেহুলচি' সম্প্রদায় ছিল জাজাবর। তাদের নাম থেকেই ‘পাতাগুন’ শব্দটি এসেছে, যেটি পরবর্তীতে অঞ্চলটির নামকরণে প্রভাব ফেলে।

অর্থনীতির চালিকাশক্তি গবাদিপশু ও খনিজ

পাতাগোনিয়ার ভূমি গবাদি পশুপালনের জন্য আদর্শ। পাম্পাস অঞ্চলে ভেড়া পালনের প্রচলন আছে। এখানকার মাটিতে নানা ফলফলাদি যেমন আপেল, আঙ্গুর, ম্যাজেলান বেরি জন্মে। অঞ্চলটি খনিজ তেল, গ্যাস, কয়লা ও লোহার মতো খনিজে সমৃদ্ধ।

পর্যটনে বিকশিত এক প্রান্তর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পাতাগোনিয়ায় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। আর্জেন্টিনার লস গ্লেসিয়ারস ন্যাশনাল পার্ক ও চিলির টরেস রেলপাইন ন্যাশনাল পার্ক এখন আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। মার্বেল গুহা ও বরফাচ্ছন্ন হিমবাহ পর্যটকদের বিস্ময় জাগায়। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী, গবেষক এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এটি এক স্বর্গীয় গন্তব্য।

একটি বিস্ময়কর প্রান্ত-প্রকৃতি, ইতিহাস ও বৈচিত্র্যের সম্মিলন

পাতাগোনিয়া যেন এক সঙ্গে ভূগোল, জলবায়ু, ইতিহাস ও জীববৈচিত্র্যের অনন্য সম্মিলন। এটি শুধু দক্ষিণ আমেরিকার নয়, পৃথিবীরও এক বিস্ময়কর প্রান্ত। এখানে এসে আপনি দেখতে পাবেন একেবারে শেষ সীমান্তের এক অনুপম চিত্র, যা আপনাকে দেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা।

 

 


সূত্র:https://tinyurl.com/5dseb85n

আফরোজা

×