
ছবি: সংগৃহীত
আমরা কি সত্যিই নিজেদের চিনতে পারি? নাকি আমাদের পরিচয়, চিন্তাভাবনা ও আচরণ অন্যদের দ্বারা গঠিত হয়? আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছে, ব্যক্তি নিজেকে একক সত্তা হিসেবে ভাবলেও তার ব্যক্তিত্বের গঠন ও বিকাশ মূলত পারিপার্শ্বিক মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী জর্জ হার্বার্ট মিড তার "The Theory of Social Self"-এ বলেছেন, মানুষের আত্মপরিচয় গঠনের প্রধান মাধ্যম হলো সমাজ। তার মতে, আমাদের নিজস্ব সত্তা বা "Self" গড়ে ওঠে অন্যদের প্রতিক্রিয়া ও সমাজের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ, আমরা যেমনটি ভাবি, তার বড় অংশই গঠিত হয় অন্যরা আমাদের কেমন দেখছে বা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে, তার ওপর নির্ভর করে।
আমাদের পরিচয়ের মূল স্তম্ভ: সমাজ ও সম্পর্ক
আমরা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসি—পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক কিংবা সমাজের অন্যান্য মানুষ। প্রতিটি মিথস্ক্রিয়া আমাদের আচরণ ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক—একজন শিশু যখন বেড়ে ওঠে, তখন সে তার পরিবারের কাছ থেকে শেখে কীভাবে কথা বলতে হয়, কোন আচরণ গ্রহণযোগ্য, কোনটি নয়। এরপর স্কুল, বন্ধুবৃত্ত, কর্মক্ষেত্র—প্রতিটি ধাপে নতুন নতুন চিন্তা ও মূল্যবোধ যুক্ত হয় তার সত্তায়।
চার্লস হর্টন কুলি এই ধারণাকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার "Looking Glass Self" তত্ত্বে। তিনি বলেছেন, আমরা আমাদের আত্মপরিচয় তৈরি করি মূলত তিনটি ধাপে—
১. আমরা কল্পনা করি, অন্যরা আমাদের কেমনভাবে দেখে।
২. আমরা কল্পনা করি, তারা আমাদের সম্পর্কে কী অনুভব করছে।
৩. আমরা সেই প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের মূল্যায়ন করি এবং পরিবর্তন করি।
ধরা যাক, যদি কেউ আমাদের মেধাবী বা আত্মবিশ্বাসী মনে করে, তাহলে আমরা নিজেকে তেমনই ভাবতে শুরু করি। আবার, যদি কেউ আমাদের ব্যর্থ বা দুর্বল বলে, তাহলে আমরা হয়তো সেই ধারণাকে সত্য ধরে নিয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারি।
আত্মপরিচয়ের পরিবর্তনশীলতা
আমরা মনে করি, আমাদের ব্যক্তিত্ব স্থির এবং নির্দিষ্ট, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। গবেষণা বলছে, আমাদের আত্মপরিচয় বিভিন্ন পরিস্থিতি ও সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন মানুষ তার পরিবারের সামনে একরকম আচরণ করে, আবার কর্মক্ষেত্রে কিংবা বন্ধুদের মাঝে ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়।
হার্ভার্ড মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গিলবার্ট তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, আমাদের চিন্তা ও ব্যক্তিত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে, যদিও আমরা মনে করি আমরা সবসময় একই রকম থাকব। তার মতে, আমাদের চারপাশের মানুষ, নতুন অভিজ্ঞতা ও সম্পর্ক আমাদের ব্যক্তিত্বকে ক্রমাগত রূপান্তরিত করে।
তাহলে আমরা আসলে কে?
এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো—আমরা কেবল নিজেদের সৃষ্টি নই, বরং আমাদের আশপাশের মানুষের প্রতিচ্ছবি। আমাদের আত্মপরিচয় সমাজ, সম্পর্ক এবং অন্যদের প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের নিজস্বতা নেই। বরং, এটি বোঝায় যে আমাদের চিন্তা ও আত্মপরিচয় গঠনে সমাজের একটি গভীর প্রভাব রয়েছে। তাই আত্মপরিচয় নিয়ে ভাবতে হলে আমাদের শুধু নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, অন্যরা আমাদের কীভাবে দেখে এবং আমরা সেই প্রতিক্রিয়াগুলো কীভাবে গ্রহণ করি, সেদিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
আসিফ