
একাডেমিক পড়ার চাপে যখন বিরক্তি আর তিক্ততা চলে আসে তখন একটু অবকাশ দরকার হয়।এই জন্য পড়ালেখার একঘেয়েমি ভাব দূর করতে ভ্রমণের বিকল্প আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না।আর সেই ভ্রমন যদি হয় একাডেমিক কোর্স সম্পর্কিত তাহলে যেন সেটি হয় সোনায় সোহাগা। যাকে বলে এক ঢিলে দুই পাখি।বলতে গেলে কলা বেচাও হলো রথ দেখাও হলো।বই এবং পিডিএফ এর স্লাইড দেখে যখন বিরক্তি অনুভূতি হয় তখন স্লাইডের পড়া গুলো বাস্তবের দেখা আর শেখা কলা বেচা ও রথ দেখার মতই।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে উত্তরবঙ্গের আলোকবর্তিকা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৩তম আবর্তনের শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে শিখতে ও জানতে একদিনের শিক্ষাসফরে যায় কোর্স শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক মো সোহাগ আলীর নেতৃত্বে। গন্তব্যে রংপর ও দিনাজপুরে সুলতানি ও মোঘল আমলের মসজিদ ভাঙনী,লাল এবং দিনাজপুরের সুরা মসজিদে।কোর্স টি ছিল বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস। সময়কাল ছিল ১২০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দ।এই কোর্সের বিষয় পড়ানো হয় সুলতানি ও মোঘল আমলের স্থাপত্যে নানা মসজিদ, মন্দির ও সমাধি।কোর্সটির মাঠ পর্যায়ে এসব স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হাতে কলমে শেখানোর জন্যই আমাদের এই সফর। সেই কারণে আমরা একটা দিনক্ষন নির্ধারণ করলাম।
২২শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় সকলে মিডিয়া চত্ত্বরে একে একে এসে উপস্থিত হই।বাসের অপেক্ষা কাটিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাস এসে পৌঁছায়। সবাই বাসে ওঠার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। বাস ছাড়তেই উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। জানালা গলে বাতাসে শো শো শব্দে এগিয়ে চলছে গাড়ি। সঙ্গে আড্ডা আর হাসি-ঠাট্টার উৎসব শুরু হয়ে যায় বাসের মধ্যে। বাস যেন কিছু সময়ের জন্য গানের মঞ্চ হয়ে যায়।হঠাৎ করে গানের আড্ডাকে আরও জমিয়ে তোলেন আমাদের কোর্স শিক্ষক। অন্যদিকে জানালায় দৃষ্টি মেলে দিগন্ত জোড়া প্রকৃতি দেখে অনেকে। গ্রামীণ জনপদ, ফসলের খেত আর নদী পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছে যায় রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ভাঙনি মসজিদে।যেটা সুলতানি আমলে নির্মিত। এর কোর্স শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক মো সোহাগ আলী আমাদের সকল কে নিয়ে মসজিদ টি পরিদর্শন করেন এবং মসজিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন।বলা হয় যে এই যে মিঠাপুকুর উপজেলার ভাঙনী ইউনিয়নে ভাঙনী মসজিদ টি মোঘল আমলের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছে।
লাল মসজিদে আমরা:
এর পর সেখান থেকে রওনা দিয়ে আমরা চলে যাই লাল মসজিদ।অনেকে বলে গড়ের মাথা মসজিদ। জানা যায় ১২২৬ হিজরি বা ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে জনৈক শেখ মোহাম্মদ সাবেরের পুত্র শেখ মোহাম্মদ আছের এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের সামনে লাগানো তথ্য কণিকা মর্মরে সুস্পষ্ট করে লেখা আছে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দের কথা। কিন্তু ইউকিপিডিয়াসহ বেশ কিছু স্থানে এর নির্মাণ সময় ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ বলা হয়েছে। মিঠাপুকুর মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল শুক্রবার। মসজিদটা মিঠাপুকুর মসজিদ নামে পরিচিত। আবার অনেকেই একে মিঠাপুকুর বড় মসজিদ আবার অনেকেই মিঠাপুকুর তিন কাতার মসজিদ বলে। এই মসজিদে এখনো নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করা হয়।
আয়তকার তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি,মসজিদের চার কোণে চারটি স্তম্ভ যা ছাদের কর্নার থেকে বেশ উপরে উঠে মুসলিম সভ্যতার নির্মাণ শৈলী পরিস্ফুটন করেছে। এটি ছোট গম্বুজের মতো কিউপোলা আকারে শেষ হয়েছে। আয়তকার মসজিদটি দুটি ল্যাটারাল খিলানের সাহায্যে তিন ভাগে ভাগ করে উপরে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি গোলাকার গম্বুজ। মসজিদের পূর্ব দিক দিয়ে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে মোট পাঁচটি প্রবেশ পথ থাকলেও এখন পূর্ব দিকের মাঝের পথটি ব্যবহার করা হয়।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট আয়তকার এই মসজিদটি আকার ১০ দশমিক ৬৬ মিটার × ৪ দশমিক ১১ মিটার। মসজিদের তিন মিহরাব, সামনের দেয়াল, প্যারাপেট দেয়াল ও গম্বুজের গোলাকার অংশে দৃষ্টিনন্দন নকশা দিয়ে আবৃত। কিছু প্যানেল করা আছে। নকশায় লতাপাতা, ফুল ও জ্যামিতিক আবহ ফুটে উঠেছে।
৪০০বছরের পুরানো সুরা মসজিদে যাত্রা:
এখানে অবস্থান করার পর আমরা চলে যাই দুপুর ১টার দিকে আমাদের সর্বশেষ ও মূল গন্তব্য জায়গা সুরা মসজিদে। নেমেই অনেকে যোহরের নামাজ আদায় করি।নামাজ শেষে মুন্না,সাকিব,সোহেল রান্না বান্নার কাজ শুরু করে দেয়।মেয়েরা গোল হয়ে মরিচ পেঁয়াজ আদা রসুন বাটার কাজ সমপূর্ন করে। বিকেল সাড়ে তিন টার দিকে স্যার আমাদের সুরা মসজিদের বর্ণনা দেওয়ার জন্য মসজিদের ভিতরে নিয়ে যায়।তিনি ঘুরে ঘুরে মসজিদের বর্ণনা করতে থাকেন।এই সুরা মসজিদ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। তাদের ধারণা, গায়েবিভাবে এক রাতেই তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ। আর এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে এবং মানত করতে প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মুসল্লিরা। রোগ থেকে মুক্তি পাওয়াসহ মনের বিভিন্ন আশা পূরণে এই সমজিদে মানত করেন তারা।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বদিকে ও ঘোড়াঘাট উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে হিলি-ঘোড়াঘাট সড়কের পাশে চৌরগাছা গ্রামে সুলতানি আমলের বিরল স্থাপত্য এই সুরা মসজিদটির অবস্থান।
সুরা মসজিদটি ২ ভাগে বিভক্ত। নামাজ ঘর ও বারান্দা। নামাজ ঘরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৭.৮৪ মিটার। বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪.৮৪ মিটার আর প্রস্থে ২.১২ মিটার। চুন-সুরকি ও ছোট আকৃতির ইট দিয়ে নির্মিত দেওয়ালগুলোর প্রস্থ ১.৮০ মিটার করে। নামাজ ঘরের ছাদ গোলাকৃতির গম্বুজ দ্বারা আবৃত। বারান্দায় রয়েছে এক সারিতে তিনটি গম্বুজ।
মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে একটি করে প্রবেশপথ রয়েছে। এছাড়াও বারান্দার চারদিকেই রয়েছে একটি করে প্রবেশপথ। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অলঙ্কৃত পাথরের তৈরি মেহরাব। মসজিদটির বাইরে পাথরের ডিজাইন করা নকশা রয়েছে। স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী সুলতানি আমলের স্থাপত্য এটি। সুরা মসজিদটি হোসেন শাহী (১৬ শতক) আমলের নিদর্শন।
বিকেল পাঁচটার দিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে গাইবান্ধার বিখ্যাত মিস্টান্ন রসমন্জুরী খাই।এর পর মাগরিবের নামাজ মসজিদে পড়ে আমরা রওনা দেই এবং রাত আট টায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাই।
ফয়সাল