ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

তারুণ্যের উদ্দীপনায় মানব কল্যাণে রেড হার্ট ফাউন্ডেশন

মনুষ্যত্বের মাহাত্ম্য মানুষ হওয়ার মধ্যে নয়, মানবিক হওয়ার মধ্যে

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

মনুষ্যত্বের মাহাত্ম্য মানুষ হওয়ার মধ্যে নয়, মানবিক হওয়ার মধ্যে

মানব জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়? অনেকের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, এবং একটি সুখী জীবন যাপন করা মানব জীবনের শ্রেষ্ঠতা। কিন্তু বহুজনের কাছে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো অন্যের মুখে হাসি ফোটানো এবং তাদের সুখী করা।

তেমনি একজন উদাহরণ হলেন শোয়াইব আরিফিন। একদিন মহাখালী ব্রীজের নিচে দুই বন্ধুকে নিয়ে চা খাচ্ছিলেন তিনি।তখনই হঠাৎ একটি পথশিশুকে দেখে তার মনে শিশুটির জন্য মায়ার সৃষ্টি হয় এবং তিনি ভাবেন এই শিশুটিও আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই একটি স্বাভাবিক জীবন আশা করে এবং এটি তার প্রাপ্য। তখন তিনি চিন্তা করেন সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করা উচিত। সেই চিন্তা থেকেই কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা রেড হার্ট ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন । শুরুতে এই ক্লাবের কাজ শুধুমাত্র রক্তদান করা থেকে শুরু হলেও, ধীরে ধীরে এর কার্যক্রমের পরিসর বৃদ্ধি পায়। 

শোয়াইব আরিফিন তখন ভাবেন সারা দেশব্যাপী এই সামাজিক কার্যক্রমগুলি চালু করা উচিত। তাই তিনি ২০২২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারীতে প্রতিষ্ঠা করেন 'রেড হার্ট ফাউন্ডেশন'। শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি ঢাকার উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চুয়াডাঙ্গা এবং কিশোরগঞ্জের মোট পাঁচটি কমিটি ছিল যার মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৬০ জন।

শুরুতে ৬০ জন সদস্য নিয়ে কাজ শুরু করলেও  বর্তমানে এই ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ৪৪টি জেলায় এবং ঢাকার নয়টি কমিটি সহ প্রায় ১২ হাজার এর অধিক সদস্য নিয়ে  তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। রেড হার্ট ফাউন্ডেশনের তরুণ-তরুণীদের মূলমন্ত্র হলো,"হেসে খেলে করি কাজ, মানবকল্যাণে রেড হার্ট"

গত তিন বছরে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের আয়োজন করেছে রেড হার্ট ফাউন্ডেশন । ঈদের সময় অসহায়দের জন্য ঈদ বাজার ও উপহার প্রদান , শীতকালে পথশিশুদের জন্য পিঠা উৎসবের আয়োজন  এবং শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। সনাতন ধর্মের পূজার সময় তীব্র দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে খাদ্য বিতরণ করেছে এই ফাউন্ডেশন  । গ্রীষ্মকালে পরিবেশ রক্ষার জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চালু করেছে।  ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হলো রক্তদান। ডেঙ্গু মৌসুমে রেড হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে ২০০-এর অধিক মানুষ রক্ত দান করেছে। উপরন্তু প্রতিবছরে একজন অসহায় ব্যাক্তিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়।

* জুলাই আন্দোলনে রেড হার্ট ফাউন্ডেশন 

জুলাই আন্দোলনের সময় রেড হার্ট ফাউন্ডেশনের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। তারা আন্দোলনকারীদের মধ্যে খাবার, পানি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করেছে। রেড হার্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান  শোয়াইব আরিফিন ও অন্যান্য সদস্যরা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় হুমকির মুখে পড়তে হয়, এমনকি শোয়াইব আরিফিন আন্দোলন চলাকালীন সময়ে  নিজের বাসায়ও যেতে পারেননি। প্রাণের  ঝুঁকি  নিয়েও আন্দোলনকারীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। মিরপুর ১০,মিরপুর ১৪ ও আগারগাঁও এলাকায় সমন্বয়কদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে এই ফাউন্ডেশন।  

আন্দোলনের পর, মিরপুর ১৪ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত তারা ট্রাফিক এবং গ্রাফিতির কাজ করেছিলেন। এছাড়াও বন্যার সময় রেড হার্ট ফাউন্ডেশন কুমিল্লা, ফেনী এবং নোয়াখালীতে ত্রাণ বিতরণ করেছে। প্রথমে তারা নোয়াখালীতে যায় এবং স্থানীয় মানুষদের সহায়তায় উদ্ধার কার্যক্রম চালায় পরবর্তীতে তারা ফেনীতে ১২০টি পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করে। এরপর তারা ঢাকায় ফিরে আসে এবং এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য লাভ করে। এই অর্থ নিয়ে তারা কুমিল্লায় যায়, যেখানে মনোহরগঞ্জ, চৌদ্দগ্রাম এবং বুড়িচং এলাকায় ১২০০ মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করে।

শোয়াইব আরিফিন সেই উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি রেড হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: ইশারাফ হোসেন মাহী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শুয়াইব সাকিব ফাউন্ডেশনের সকল কাজ সার্বিকভাবে তদারকি  করছেন এবং তাদের সহযোগিতা করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি অফ ফটোগ্রাফি তৌকির আহসান, ডেভেলপমেন্ট অফিসার ইকরামুল তালুকদার সামি, জয়েন্ট সেক্রেটারি ফারহান শাহরিয়ার তৌশিক এবং সেক্রেটারি অফ আইটি নাজিয়া কবির নিলা।  প্রশাসনিক কাজ করেন কেন্দ্রীয় কমিটির ডিরেক্টর অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আপন দুলাল শাওন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও তথ্য প্রযুক্তির কাজ করেন তানজিম আহমেদ তামিম এবং রক্ত ব্যবস্থাপনার কাজ করেন নওশীন আনিকা। রেড হার্ট ফাউন্ডেশনে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। 

রেড হার্ট ফাউন্ডেশন নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা শোয়াইব আরিফিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হল পথশিশুদের জন্য 'পথের প্রদীপ' নামে একটি বিদ্যালয় নির্মাণ করা , যেখানে তাদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি  একবেলা খাবারের ব্যবস্থাও থাকবে। এছাড়াও, প্রতি সপ্তাহে একটি করে সমাজসেবা কার্যক্রম করতে চায় এই ফাউন্ডেশন । "এক পয়সার হাসি" নামে একটি খাবারের হোটেল খোলার পরিকল্পনা রয়েছে , যেখানে সমাজের দরিদ্ররা এক টাকা দিয়ে পরিপূর্ণ আহার পাবে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (IHL) প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করতে চায় এই ফাউন্ডেশন। 

রেড হার্ট ফাউন্ডেশন শিক্ষার্থীদের টাকায় পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীরা প্রতিমাসে তাদের হাত খরচের টাকায় ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। এই ফাউন্ডেশনে যোগদান করে শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে, নেতৃত্বগুণ ও তথ্য-প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। ❝কারো কষ্ট দেখে আপনার মন যদি অস্থির হয়, তাহলে বুঝবেন আপনি মানুষ। আপনার মধ্যে এখনো মানবতা বেঁচে আছে।❞ তারা বিশ্বাস করে একদিন এই গোটা পৃথিবীতে তারা তাদের এই সেবামূলক কার্যক্রম গুলো পৌঁছে দিতে পারবে, সব অসহায় মানুষের মুখে তারা হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারবে।

এই বিশ্বাস নিয়ে রেড হার্ট ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য একটি মানবিক পৃথিবী তৈরির লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে। রেড হার্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শোয়াইব আরিফিনের বিশ্বাস তরুণদের এইসব ভালো কাজের সঙ্গে জড়িত করলেই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের জন্য আরও পরিশ্রমী ও উদ্যমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

রিফাত

×