ছবি : সংগৃহীত
প্যারেন্টিং একটি সূক্ষ্ম বিষয়। আপনার সন্তানের সঠিক পথে দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং অতিরিক্ত প্যারেন্টিং করার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সীমারেখা রয়েছে।
অতিরিক্ত প্যারেন্টিং, বা ‘হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং’, এমন একটি শৈলী যেখানে বাবা-মা তাদের সন্তানের জীবনে অতিরিক্ত জড়িয়ে পড়েন, প্রায়শই মাইক্রোম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে পৌঁছে যান। এটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে, যা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নির্দিষ্ট কিছু আচরণে প্রকাশ পায়।
আপনি যদি জানতে চান এই আচরণগুলো কেমন হতে পারে, তাহলে আমার সঙ্গে থাকুন। আমি এখন শেয়ার করতে যাচ্ছি ৯টি সুস্পষ্ট লক্ষণ, যা বোঝাতে পারে যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শিশুকালে অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার হয়েছেন।
চলুন, একসাথে এই ৯টি আচরণ অন্বেষণ করি।
১) স্বাধীনতার সঙ্গে সংগ্রাম
অতিরিক্ত যত্নশীল প্যারেন্টিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা প্রায়ই নিজেদের স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে সমস্যায় পড়েন।
সবসময় কাউকে পাশে পেয়ে, যিনি তাদের পথ দেখিয়েছেন, সমস্যা সমাধান করেছেন বা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এভাবে বড় হওয়া ব্যক্তিরা যখন সেই প্যারেন্টাল নিয়ন্ত্রণ হারান, তখন তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তারা অক্ষম। তবে তারা এমনভাবে গড়ে উঠেছেন যে তারা অন্যের নির্দেশনার উপর নির্ভর করতে অভ্যস্ত। এ কারণে, স্বাধীনতা তাদের জন্য নতুন ও অনেক সময় ভীতিকর ধারণা হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সেই সিদ্ধান্তের পরিণতির মুখোমুখি হওয়া শিখতে হয়। এটি একটি শেখার প্রক্রিয়া, যা অনেক অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার প্রাপ্তবয়স্কদের পার করতে হয়।
যদি আপনি কোনো প্রাপ্তবয়স্ককে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট করতে দেখেন, এটি ইঙ্গিত করতে পারে যে তারা শিশুকালে অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার হয়েছিলেন।
২) ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা
যে ব্যক্তি অতিরিক্ত যত্নশীল প্যারেন্টিংয়ের শিকার হয়েছেন, তার জন্য ঝুঁকি নেওয়া সহজ নয়।
‘হেলিকপ্টার’ প্যারেন্টিং প্রায়ই ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করে। কারণ এই ধরণের প্যারেন্টিং মূলত আমাদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, যেখানে ঝুঁকি অনেক সময় ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
আমি মনে করি, যখন আমি কলেজ শেষ করার পর একা ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার বাবা-মা ভেবেছিলেন যে এটি একদমই অসম্ভব। তারা এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে কী কী ভুল হতে পারে, তারা সেই ভ্রমণের শিক্ষামূলক দিকগুলো বুঝতেই পারেননি।
তাদের ভয় আমার মধ্যেও স্থান পেয়েছিল। আমি আমার নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করলাম এবং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলাম। শেষ পর্যন্ত আমি সেই ভ্রমণে যাইনি।
৩) উচ্চ মাত্রার উদ্বেগ
অতিরিক্ত যত্নশীল প্যারেন্টিং প্রায়ই প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উচ্চ মাত্রার উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
‘হেলিকপ্টার প্যারেন্টদের’ অধীনে বেড়ে ওঠা শিশুদের প্রায়ই চ্যালেঞ্জ এবং কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করা হয়। তাদেরকে সমস্যাগুলো সরাসরি মোকাবিলা করার সুযোগ দেওয়া হয় না বা ভুল থেকে শিখতে দেওয়া হয় না।
ফলে, তারা ব্যর্থতার একটি তীব্র ভয় এবং একটি অতিরিক্ত স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, অতিরিক্ত যত্নশীল প্যারেন্টিংয়ের শিকার শিশুদের মধ্যে কর্টিসল, একটি স্ট্রেস হরমোন, বেশি পরিমাণে থাকে।
তাই, যদি আপনি এমন একজন প্রাপ্তবয়স্ককে দেখেন যিনি চ্যালেঞ্জ বা সম্ভাব্য ব্যর্থতার মুখোমুখি হলে অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন বা মানসিকভাবে চাপ অনুভব করেন, এটি ইঙ্গিত করতে পারে যে তারা অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার হয়েছিলেন।
৪) সমস্যা সমাধানের দক্ষতার অভাব
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সন্তানের সমস্যা সমাধানে সর্বদা এগিয়ে আসা। যদিও এটি ভালোবাসা এবং সুরক্ষার উদ্দেশ্যে করা হয়, এটি সন্তানের সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা গড়ে তুলতে বাধা দেয়।
যখন তারা প্রাপ্তবয়স্ক হন, তখন অনেক সময় সমস্যার মুখোমুখি হলে তারা দ্বিধায় পড়ে যান। তারা নিজেরাই সমাধান খুঁজে বের করতে কষ্ট করতে পারেন বা সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
৫) ব্যর্থতার সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা
ব্যর্থতা জীবনের একটি অংশ। এটাই আমাদের শেখায়, বড় করে তোলে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্থিতিস্থাপক করে। কিন্তু যেসব মানুষ অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য ব্যর্থতা মেনে নেওয়া খুব কঠিন হতে পারে।
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের প্রায়ই ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করা হয়। বাবা-মা নিশ্চিত করেন যে তাদের সন্তান সবসময় সফল হয়। তবে এই সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে।
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার প্রাপ্তবয়স্করা প্রায়ই ব্যর্থতার সাথে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক কৌশল গড়ে তুলতে পারেন না। তারা ব্যর্থতাকে খুব ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারেন বা যখন কোনো কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী না হয় তখন নিজেদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর হয়ে ওঠেন।
৬) ক্রমাগত স্বীকৃতির প্রয়োজন
আমরা সবাই একটু প্রশংসা পেতে পছন্দ করি, তাই না? আমাদের প্রচেষ্টার জন্য স্বীকৃতি পাওয়া ভালো লাগে। কিন্তু অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার ব্যক্তিদের জন্য এই স্বীকৃতির প্রয়োজন শুধুমাত্র ভালো লাগার বিষয় নয়, এটি অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায়।
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার শিশুরা প্রায়ই তাদের বাবা-মায়ের নজরদারিতে বড় হয়, যারা নিয়মিত প্রতিক্রিয়া এবং স্বীকৃতি প্রদান করেন। যখন তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন এই অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা অদৃশ্য হয় না। বরং, এটি আরও তীব্র হতে পারে।
তারা প্রায়ই তাদের সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরিচিত মানুষের কাছ থেকেও স্বীকৃতি চাইতে পারে। এটি তাদের অহংকারী বা মনোযোগ-প্রত্যাশী হওয়ার কারণে নয়। এটি তাদের বড় হওয়ার পরিবেশ এবং আত্ম-মূল্যবোধের একটি অংশ।
৭) নিয়ম এবং কাঠামোর উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা
আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন আমার চারপাশ নিয়মে ভরা ছিল। সময় মেনে বাড়ি ফেরা, পড়াশোনার নির্দিষ্ট সময়, খাবার খাওয়ার নির্দিষ্ট সময়—আমার বাবা-মায়ের সবকিছুর জন্য একটি নিয়ম ছিল। তারা অবশ্যই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এটি করতেন, আমার মধ্যে শৃঙ্খলা এবং ভালো অভ্যাস তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আমি লক্ষ্য করেছি যে এই নিয়ম এবং কাঠামোর উপর নির্ভরতা আমার জীবনে বজায় রয়েছে। আমি তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে বা রুটিন ভেঙে বের হতে কঠিন মনে করি। যেন আমি একটি কঠোর সময়সূচী অনুসরণ করতে ‘প্রোগ্রাম’ হয়ে গেছি, এবং এর বাইরে কিছু হলে আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।
যদি আপনি এমন কোনো প্রাপ্তবয়স্ককে দেখেন, যিনি স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে অস্বাভাবিকভাবে অস্বস্তি বোধ করেন বা কঠোরভাবে রুটিন মেনে চলেন, তাহলে তারা সম্ভবত অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার। এটি তাদের রক্ষণশীল বা অনমনীয় হওয়ার জন্য নয়। তারা নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ম এবং কাঠামোর উপর নির্ভর করতে শিখেছেন।
৮) সম্পর্ক গঠনে সমস্যা
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার শিশুরা প্রায়ই এমন একটি পরিবেশে বেড়ে ওঠে যেখানে তাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়াগুলি এতটাই নিয়ন্ত্রিত হয় যে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সম্পর্ক গঠনে সমস্যায় পড়ে।
তারা হয়তো অন্যদের সাথে গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করতে বা দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক বজায় রাখতে কঠিন মনে করতে পারে।
এটি তাদের অসামাজিক বা সহানুভূতির অভাবে নয়। এটি প্রায়ই ঘটে কারণ তাদের সামাজিক জীবনে বাবা-মায়ের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ তাদের সম্পর্কগুলো স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার দক্ষতা গড়ে তুলতে বাধা দিয়েছে।
যদি আপনি এমন একজন প্রাপ্তবয়স্ককে দেখেন, যিনি সম্পর্ক গড়ে তুলতে বা বজায় রাখতে সমস্যায় পড়েন, এটি অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের একটি ফলাফল হতে পারে। এটি কোনো চরিত্রগত ত্রুটি নয় বরং একটি এমন শৈশবের প্রতিফলন যেখানে স্বাধীন সামাজিক বিকাশের সুযোগের অভাব ছিল।
৯) আত্মমর্যাদার অভাব
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, অতিরিক্ত প্যারেন্টিং একটি ব্যক্তির আত্মমর্যাদার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
যখন বাবা-মা সর্বদা সমস্যার সমাধান করেন এবং সন্তানের জন্য সিদ্ধান্ত নেন, তখন এটি অনিচ্ছাকৃতভাবে এই বার্তা দেয় যে শিশু নিজে জিনিসগুলি পরিচালনা করতে সক্ষম নয়।
এই শিশুরা যখন বড় হয়, তখন তারা প্রায়ই নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ করতে পারে বা তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
যদি আপনি এমন একজন প্রাপ্তবয়স্ককে দেখেন, যিনি প্রায়ই নিজের ক্ষমতাকে খাটো করেন বা আত্মসম্মান নিয়ে লড়াই করেন, এটি অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের একটি ফলাফল হতে পারে। এটি দুর্বলতার লক্ষণ নয় বরং এমন একটি শৈশবের প্রতিফলন যেখানে তারা নিজের মূল্য নিজেই প্রমাণ করার সুযোগ খুব কম পেয়েছে।
যাত্রার প্রতিফলন
মানব আচরণের জটিলতা আমাদের শৈশবের লালন-পালনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই ধাঁধার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আমরা কীভাবে শৈশবে প্যারেন্টিং পেয়েছি।
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের প্রভাব প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে—স্বাধীনতা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে শুরু করে আত্মসম্মান ও সম্পর্ক গঠনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত।
কিন্তু এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এই আচরণগুলো স্থায়ী নয়। সচেতনতা, বোঝাপড়া এবং কখনো পেশাদার সাহায্যের মাধ্যমে অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের শিকার ব্যক্তিরা এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে পারে।
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্স বলেছেন,
“শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিই শিক্ষিত, যিনি কীভাবে শিখতে এবং পরিবর্তন করতে হয় তা শিখেছেন।”
অতিরিক্ত প্যারেন্টিংয়ের প্রভাব নিয়ে লড়াই করা ব্যক্তিদের জন্য এই উক্তিটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
যদি আপনি নিজের মধ্যে বা পরিচিত কারো মধ্যে এই আচরণগুলো দেখতে পান, মনে রাখবেন এটি একটি চিরস্থায়ী অবস্থান নয়। এটি পরিবর্তন এবং রূপান্তরের একটি সুযোগ।
তাই আসুন আমরা এটি সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার সঙ্গে বিবেচনা করি, বুঝতে চেষ্টা করি যে প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব আত্ম-অন্বেষণ এবং বৃদ্ধি যাত্রায় রয়েছে। এবং মনে রাখবেন, শেখা, পরিবর্তন এবং বিকশিত হওয়ার জন্য কখনই দেরি হয় না।
মো. মহিউদ্দিন