ছবি : সংগৃহীত
শীতকাল মানেই ভ্রমণের মৌসুম। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে প্রকৃতি তার চিরাচরিত নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ফিরে পায়। সেই সৌন্দর্যের মোহে সারাদেশের পর্যটন স্পটগুলোতে বাড়ে পর্যটকের সংখ্যা। চলতি বছর শীতের হাওয়া লাগতেই ভ্রমণপিপাসুদের অনেকেই ঘুরতে বেড়িয়েছেন, আবার অনেকে ঘোরার পরিকল্পনা করছেন। এবারের শীতে দেশের কোন কোন স্থান ঘুরতে যেতে পারেন, চলুন জেনে নেওয়া যাক-
পঞ্চগড়
বাংলাদেশের হিমালয় কন্যা খ্যাত জেলা পঞ্চগড়। হিমালয়ের পাদদেশে জেলাটির ভৌগোলিক অবস্থান হওয়ায় পঞ্চগড়কে বলা হয় হিমালয় কন্যা। কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। প্রতি বছর শীতের সময় বাংলাদেশ থেকে দেখা মেলে এই পর্বতের। পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়া থেকে স্পষ্টভাবে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখা মেলে পর্বতের।
শীতের আকাশ মেঘমুক্ত ও পরিষ্কার থাকায় ভেসে ওঠে তুষার শুভ্র হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরের সরকারি ডাকবাংলো চত্বর কিংবা জিরো পয়েন্ট থেকে দেখা মেলে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পর্বতের। পাশাপাশি স্পষ্টভাবে দার্জিলিংয়ের সবুজে ঘেরা পাহাড় শ্রেণিও দেখা যায়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সর্ব দক্ষিণের মাত্র ১৭ বর্গকিলোমিটারের এই ক্ষুদ্র দ্বীপটির অবস্থান কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। একদিকে নীল দিগন্তের কোণে ফেনিল সমুদ্রের মিশে যাওয়া, অন্যদিকে সারি সারি নারিকেল গাছ ঘেরা সাধারণ জীবন ভ্রমণপিপাসুকে অমোঘ আকর্ষণে কাছে টানে।
সুন্দরবন
বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও ভারতের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ইউনেসকো স্বীকৃত এই বনাঞ্চলটি বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণের আধার। এখানে জন্মানো সুন্দরী বৃক্ষের কারণে সুন্দরবন নামেই বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের এই প্রধান বিচরণক্ষেত্রটি।
এখানে ঘুরতে যেতে হলে অবশ্যই বন অধিদপ্তর নির্ধারিত ফি দিয়ে অনুমতি ও সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষী নিতে হয়। সেখানকার সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার একমাত্র মাধ্যম লঞ্চ ও ছোট জাহাজ। আগে সুন্দরবনে সাধারণত সবাই খুলনা বা মোংলা হয়েই যেত। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে এখন সড়কপথেই সুন্দরবন ভ্রমণে যেতে পারছেন পর্যটকরা।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সাগরের উত্তাল ঢেউ যে কারও মন ভালো করে দেয়। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় সারা দিন। এ কারণেই ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতে থাকে পর্যটকদের ভিড়। এখন ট্রেনেও সহজেই যেতে পারেন কক্সবাজার। এছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল, কলাবাগান, সায়েদাবাদ থেকে অধিকাংশ পর্যটক বাসেও যেতে পারেন কক্সবাজার। যেতে সময় লাগে ৮-১০ ঘণ্টা।
আবার চাইলে আকাশপথেও যেত পারেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস, ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার দিনে ২০টির বেশি ফ্লাইট কক্সবাজারে পরিচালনা করে। ফলে এক ঘণ্টারও কম সময়ে কক্সবাজার যেতে পারছেন পর্যটকরা।
মালনীছড়া চা বাগান
উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান হলো সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান। ১৮৪৯ সালে লর্ড হার্ডসনের তত্ত্বাবধানে এক হাজার ৫০০ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় এই চা বাগান। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে থাকলেও চা বাগানপ্রিয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ পছন্দের একটি জায়গা হয়ে উঠেছে।
কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ানো যায় বাগানে। বাস, ট্রেন অথবা বিমান- এই তিন রুটের যে কোনোটি ব্যবহার করে ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে সিলেট। এরপর শহরের যে কোনো জায়গা থেকে রিকশা কিংবা সিএনজিতে সহজেই যেতে পারবেন মালনীছড়া চা বাগানে।
কুতুবদিয়া দ্বীপ
বাংলাদেশে বাতিঘর দেখতে হলে চলে যেতে হবে কক্সবাজার জেলার ছোট উপজেলা কুতুবদিয়ার এই দ্বীপটিতে। এখানকার প্রাচীন বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষটি এখনো যেন ভাটার সময় পুরোনো ইতিহাসের গল্প বলে। ২১৬ বর্গকিলোমিটারের ছোট এই দ্বীপে আছে নির্জন সমুদ্র সৈকত ও কুতুব আউলিয়ার মাজার।
বাংলাদেশের একমাত্র বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও প্রাকৃতিকভাবে লবণ চাষের জন্য এ জায়গাটি বেশ প্রসিদ্ধ। এই দ্বীপ ভ্রমণের জন্য কক্সবাজার থেকে প্রথমে চকরিয়া বাসস্ট্যান্ড আসতে হবে। সেখান থেকে সিএনজিতে মগনামা ঘাট পৌঁছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে যেতে হবে কুতুবদিয়া চ্যানেলে। কুতুবদিয়া চ্যানেলই পৌঁছে দেবে কুতুবদিয়া দ্বীপে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
১২৫০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও আংশিক শ্রীমঙ্গল নিয়ে। দেশের ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত এজাতীয় উদ্যানটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর নান্দনিক সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন।
৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ ও ২৪০ প্রজাতির পাখির আশ্রয়স্থল এই লাউয়াছড়া। বিশেষ করে বিলুপ্ত প্রায় উল্লুকের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা হিসেবে এর সুখ্যাতি আছে। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে লাউয়াছড়া ভ্রমণ করা যায়।
মনপুরা দ্বীপ
ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন ভূমিটি সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত ও হরিণ দেখার জন্য পর্যটকদের প্রিয় স্থান মনপুরা দ্বীপ। মেঘনা নদীর ভেতরে ৫০০ মিটার পর্যন্ত স্থাপন করা মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশনে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকদের ভিড় থাকে। দ্বীপ ভ্রমণে এসে দর্শনার্থীরা চৌধুরি প্রজেক্টের মাছের ঘের ও সারি সারি নারিকেল গাছের বিস্তৃত এলাকায়ও ঘুরতে আসেন।
নদীর ধারে সাইক্লিং কিংবা সবুজের মাঝে ক্যাম্পিং করার জন্য সেরা জায়গা হলো মনপুরা দ্বীপ। মনপুরা দ্বীপে যাওয়ার জন্য ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকেল ৫টায় লঞ্চে উঠতে হবে। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়কপথে ভোলা হয়ে তজুমদ্দিন ঘাটে এসে সিট্রাকেও মনপুরা দ্বীপে আসা যায়। সিট্রাক ছাড়ার সময় বিকেল ৩টা।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা অবস্থিত সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। এটি প্রায় ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রায় ৬২ প্রজাতির প্রাণী এবং প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখির আবাস।
এই অভয়ারণ্যে আছে অপরূপ সুন্দর তিনটি ট্রেইল, গোটা বন একনজরে দেখার জন্য আছে সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছে টমটমে চড়ে যেতে হবে নতুন ব্রিজ। সেখান থেকে সিএনজিতে চুনারুঘাট মধ্যবাজার পৌঁছে আরেকটি সিএনজিতে কালেঙ্গা বাজার নামতে হবে। এরপর ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই অভয়ারণ্যের প্রধান ফটক।
নিঝুম দ্বীপ
নোয়াখালীর হাতিয়া অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরে ঘেরা ছোট্ট এই দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর। শীতের মৌসুমে পুরো নিঝুম দ্বীপ ভরে যায় অতিথি পাখিতে। এখানকার সবচেয়ে সেরা আকর্ষণ হচ্ছে চিত্রা হরিণ। একসঙ্গে এত চিত্রা হরিণের দেখা দেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। নিঝুম দ্বীপের নামাবাজার সৈকত থেকে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য।
সড়কপথে যে কোনো যানবাহনই ব্যবহার করা হোক না কেন, নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে প্রথমে পৌঁছাতে হবে চেয়ারম্যান ঘাটে। এখানকার হাতিয়া যাওয়ার সি-ট্রাক বা ট্রলারগুলো নলচিরা ঘাটে নামিয়ে দেবে। এরপর মোটরসাইকেলে পৌঁছাতে হবে হাতিয়ার অন্য প্রান্ত মোক্তারিয়া ঘাটে। সেখান থেকে ট্রলারে নিঝুম দ্বীপ। তবে সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়ার লঞ্চে ওঠে পড়া। হাতিয়ায় পৌঁছার পর তমুরদ্দীঘাট থেকে পাওয়া যাবে সরাসরি নিঝুম দ্বীপের ট্রলার।
শীতকালে ভ্রমণের সময় অবশ্যই সঙ্গে গরম কাপড় নেওয়া আবশ্যক। এছাড়া ওষুধপত্রের সঙ্গে ডেটল, স্যাভলন, ব্যান্ডেজ ও তুলার মতো কিছু ফার্স্ট এইড সামগ্রী সঙ্গে রাখা উচিত। সুপরিকল্পিত পূর্ব প্রস্তুতিই পারে একটি ভ্রমণ নিরাপদ করে তুলতে।
মো. মহিউদ্দিন