ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

সঙ্গীত জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ

শরিফুল রোমান, গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

সঙ্গীত জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ

ছবি সংগৃহীত

উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রাম যেন একটি সঙ্গীতময় গ্রাম। এই গ্রামেই আয়েত আলী খাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম সবদার হোসেন খাঁ, ডাক নাম সদু খাঁ।

১৮৮৪ সালের ২৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামে এক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিবারে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর জন্ম। তাঁর পিতা সবদার হোসেন খাঁ (সদু খাঁ) একজন সঙ্গীতজ্ঞ।

সবদার হোসেন সদু খাঁ ছিলেন আগরতলা রাজ দরবারের সভাবাদক ওস্তাদ কাশেম আলী খাঁর শিষ্য। সদু খাঁর পাঁচ পুত্র—ছমির উদ্দিন খাঁ, আফতাবউদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, নায়েব আলী খাঁ এবং আয়েত আলী খাঁ। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আয়েত আলী খাঁ।

আয়েত আলী খাঁ বাল্যকাল থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। পিতা শিল্পী, বড় ভাইয়েরাও সবাই শিল্পী—পরিবারের সকলের রক্তেই যেন সঙ্গীত প্রবাহিত। পিতা সম্ভাবনার হাতছানি দেখেছিলেন ছোট আয়েত আলীর মধ্যে।

তাই ছোটবেলায় আয়েত আলী খাঁকে কখনও সঙ্গীতচর্চায় বাধা দেননি, তবে মা দিয়েছিলেন। একের পর এক সন্তান সঙ্গীতের পেছনে ছুটে পড়ছিল, যা মায়ের জন্য বেদনার ছিল। অন্তত ছোট ছেলেকে নিজের আঁচলে বাঁধতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা সফল হয়নি।

দশ বছর বয়সে আয়েত আলী খাঁ অগ্রজ ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর নিকট সঙ্গীতশিক্ষা শুরু করেন। সাত বছর সরগম সাধনা ও রাগ-রাগিণী রেওয়াজ করার পর তিনি ভারতের মাইহারে গিয়ে অপর অগ্রজ আলাউদ্দিন খাঁর নিকট সঙ্গীতের তালিম নেন।

প্রথম পর্বে তিনি সেতার এবং দ্বিতীয় পর্বে সুরবাহার শেখেন। আলাউদ্দিন খাঁ কনিষ্ঠ ভ্রাতার মধ্যে রাগ-আলাপে আকর্ষণ ও নিষ্ঠা দেখে তাঁকে সুরবাহার শেখান। আয়েত আলীও অগ্রজের নির্দেশ অনুযায়ী বাদনকৌশল ও রাগ রূপায়ণের সূক্ষ্ম বিষয়গুলি নিষ্ঠার সঙ্গে আয়ত্ত করেন।

পরে আলাউদ্দিন খাঁ তাঁকে নিজ গুরু ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট রামপুরে পাঠিয়ে দেন। ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ফলে আয়েত আলী খাঁ ওস্তাদের মন জয় করতে সক্ষম হন এবং তাঁর নিকট দীর্ঘ তেরো বছর শিক্ষাগ্রহণ করেন।

শিক্ষা সমাপ্তির পর আয়েত আলী মাইহার রাজ্যের সভাবাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মহারাজ তাঁর আসন নির্দিষ্ট করেন অগ্রজ আলাউদ্দিন খাঁর পাশেই।

এই সময় দু'ভাই প্রাচ্যদেশীয় যন্ত্রসমন্বয়ে একটি অর্কেস্ট্রা দল গঠন করেন এবং প্রমাণ করেন যে, এ দেশের বাদ্যযন্ত্রের কনসার্ট পাশ্চাত্যের অর্কেস্ট্রার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আয়েত আলী পরে রামপুরের রাজ দরবারেও বাদ্য পরিবেশন করেন।

১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে তিনি শান্তিনিকেতন যান এবং বিশ্বভারতীর যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন।

উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যবাহী ধারাকে সচল রাখা, নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা এবং বিশেষ করে যন্ত্রবাদনের ক্ষেত্রে আয়েত আলী খাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘আলম ব্রাদার্স’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে গবেষণার মাধ্যমে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবন করেন। মনোহরা ও মন্দ্রনাদ বাদ্যযন্ত্রদুটি তাঁরই সৃষ্টি।

তিনি সুরবাহার ও সরোদ যন্ত্রের নতুন রূপ দেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরামর্শে চন্দ্রসারং যন্ত্রটিও তৈরি করেন। তিনি বারিষ, হেমন্তিকা, আওল-বসন্ত, ওমর-সোহাগ, শিব-বেহাগ, বসন্ত-ভৈরোঁ, মিশ্র সারং প্রভৃতি রাগেরও স্রষ্টা।

বিশুদ্ধ রাগসঙ্গীতের চর্চা, সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য আয়েত আলী খাঁ ১৯৪৮ সালে কুমিল্লায় এবং ১৯৫৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘আলাউদ্দিন মিউজিক কলেজ’ নামে দুটি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।

১৯৫১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান রেডিওতে নিয়মিত সুরবাহার পরিবেশন করেন।

সঙ্গীতে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি গভর্নর পদক (১৯৬০), পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬১) এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ (১৯৬৬) লাভ করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (মরণোত্তর, ১৯৭৬) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৮৪) লাভ করেন।

১৯৬৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর উপমহাদেশের এই খ্যাতিমান উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পী আয়েত আলী খাঁ মৃত্যু বরণ করেন।

আশিক

×