
ছবিঃ সংগৃহীত
পুইশুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সুনীল কুমার বিশ্বাস রবি ও বুধবারে রাহুথোড় হাটে প্রায়ই আসতেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। হাতিয়াড়ার এক ছোট ছেলে মিতুল প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, ইংরেজি গ্রামার শেখার ইচ্ছা তার। মা-ও চান তার ছেলে লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক। সুনীল বাবুর সঙ্গে দেখা করে বললেন, "কাকু, আমার মিতুলরে একটু ইংরেজি শিখাইয়া দাও।"
তিনি বললেন, "মাগো, তোর ছেলের কষ্ট করে পুইশুর যাওয়ার দরকার নেই। আমি তো হাটবারে রাহুথোড় হাটে আসি। তোর ছেলে যদি এ সময়ে আমার কাছে যায়, তখনই তারে যা পারি শিখাইয়া দেবো।"
প্রতি হাটবারে এক ছোট ছেলে পরম আগ্রহে খাতা-কলম নিয়ে বসে থাকে, কখন সুনীল দাদু হাটে আসেন। এভাবেই চলে রাহুথোড় হাটে দোকান-পাট আর লোকজনের ফাঁকে তার ইংরেজি গ্রামার শেখা—কখনো হাট শুরুর আগে, কখনো হাটের শেষে। এমন করেই রাহুথোড় হাটের কোলাহলের মধ্যেই মিতুলের ইংরেজি শেখার জীবন শুরু হলো সুনীল স্যারের হাত ধরে।
নানান কথার মধ্যে আজ মিতুলের কাছ থেকে শোনা এই ঘটনা।
মিতুলের কাহিনী শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল আমার ইংরেজি শেখার কথা। ভাদ্র-আশ্বিন মাস, যখন জল চারিদিকে থৈ থৈ করতো, তখন একখানা বাঁশের বৈঠা হাতে নৌকা বেয়ে দুর্বাশুর আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহাদেব বালা মহাশয়ের বাড়িতে যেতাম। আমাদের গ্রাম বহুগ্রামের পাশের গ্রাম দুর্বাশুর। নৌকা বাঁধতাম ঘরের সামনে একটা কূল গাছের সাথে। সে সময় আষাঢ় মাস থেকে বর্ষাকালে চারিদিক ডুবে যেত, শুধু বাড়িগুলো জেগে থাকতো।
স্যার আমাকে Tense শেখাতেন:
“তেছি, তেছো, তেছে যদি ক্রিয়ার শেষে রয়,
Present Continuous Tense জানিয়ে নিশ্চয়।”
ছন্দে ছন্দে উচ্চারণ করতেন আর বোঝাতেন।
কোনো স্বার্থ ছাড়া, শুধু ভালবেসে, নিভৃতে তার স্নেহের ছাত্রকে জ্ঞান দানের আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা আমাকে আজও কেমন বিহ্বল করে।
অনেক দিন পড়া শেষ হলে নৌকা পেতাম না, কেউ নিয়েছে জাল ছাওয়ার জন্যে। আসতে দেরি হতো।
স্যারের লেখা এবং শেখানো Tense-এর খাতা খানা অনেক বছর আমার কাছে ছিল।
সুনীল স্যার, মহাদেব বালা স্যার যদি আজও থাকতেন, হাটের ফাঁকে বা সকালে ঘরের চৌকিতে বসে পড়াতেন মিতুল বা আমার মতো কাউকে, কেমন হতো সে সময়টুকু! কেমন হতো আমাদের আজকের জীবন, আজকের সমাজ আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা!
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহাদেব বালা আজ আমাদের সঙ্গে নেই। তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও নিরন্তর কৃতজ্ঞতা।
শ্রদ্ধা জানাই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুনীল কুমার বিশ্বাসকে।
এমন গুণী শিক্ষকদের অপেক্ষায় প্রতিক্ষণ আমরা।
মারিয়া