
লাল গেঞ্জি পরা ছেলেটির দিকে আমি তাকিয়েছিলাম ও আমার মতো আরও দুই একজন দেখছিল ছেলেটিকে। ছেলেটি রাস্তার পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে চা ওয়ালার সাথে কি নিয়ে যেন তর্কে জড়িয়ে গিয়েছে। কিছুটা দূর থেকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আসলে তর্কটা কি নিয়ে হচ্ছে!
অমল আমার পাশে পাশে হাঁটছিল ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে, একটু থেমে হাত ধরে টান দিল, কি দেখতেছেন, ওর মাথাটা একটু গরম আছে, একটু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে-’
ছেলেটা কে?
ওরে আপনি চিনবেন না। মাঝের চরের মর্জিনার পোলা, কয়েকদিন হয় এইখানে আসছে, দুই চার দিন পর আবার খুলনায় চলে যাবে, ও ওর বউ নিয়া ওইখানেই থাকে, বাপ নাই, সে মরছে সিডরে। এখানে এখন ওর মা একা থাকে, তাকে দেখবার জন্য মাঝে মাঝে আসে, টাকা পয়সা দিয়া যায়।
সামনের দিকে পা বাড়াই ও সূর্যের আলোর তাপ বাড়ছে। ছায়ায় যাওয়া দরকার।
সকালের দিকটা এরকম ছিল না। আবহাওয়া ছিল বেশ ঠান্ডা ও শান্ত পরিবেশে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় গাছ-গাছালির সবুজ পাতায় সকালের লালচে সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছিল ও তবে সে আলোয় তাপের আভাস ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, সূর্য উপরে ওঠার সাথে সাথে ধীরে ধীরে তাপ বাড়বে ও কিছুদিন ধরে এমনটাই চলছে।
গ্রামের বাড়িতে এসেছি দিন চারেক হলো। ভেবেছিলাম, গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছে, এই সময়টা গ্রামীণ পরিবেশে কাটিয়ে গেলে ভালোই হবে।
এখানে আসার পরে দু-তিন দিন বাড়ির আশপাশেই ঘোরাঘুরি করেছি। আজকে অমলকে নিয়ে চলে এসেছি নদী তীরবর্তী বন্দরের দিকে।
কিছুটা দূরের আত্মীয় অমল আমাদের বাড়িতেই থাকে। আর অনেকদিন ধরে থাকার জন্য এদিকের সবকিছুই তার চেনা জানা হয়ে গেছে। বয়স তেমন বেশি নয়, তবে স্বভাবগতভাবে বেশ বুদ্ধিমান, চালাক চতুরও।
ওই ছেলেটা কোথায় থাকে যেন বলছিলে? আমি অমলের দিকে তাকাই।
ওই তো মাঝের চরে। নদীর ওপারের দিকে ইঙ্গিত করে অমল। বলে, অনেক আগে একবার গেছিলেন না ওই খানে, মনে নাই?
অনেক দিনের ভুলে যাওয়া কিছু ঘটনার কথা হঠাৎ যেন মনের মধ্যে চলে আসে।
তাইতো, দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই ভয়াবহ ‘সিডর’র ধ্বংসযজ্ঞের কথা তো এ অঞ্চলের মানুষ এখনো ভোলেনি। একটি বিদেশি বার্তা সংস্থায় কাজ করার সুবাদে সেবার সিডরের পরে আমিও তো একবার এখানে এসেছিলাম। সেটাই বা আমি ভুলে গেলাম কি করে!
একটু দূরেই নদীর পাড়। তাই এ দিকে কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা চলে গেলাম নদীর পাড়ে। একটা গাছের ছায়ার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেলা বেড়েছে। মাথার উপরের আকাশ থেকে যেন আগুনের হলকা নেমে আসছে। মাঝে মাঝে তার স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। গরম হাওয়া উড়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর পাতার নিচে নাম না জানা কিছু পোকা এসে ছায়ায় লুকিয়েছে।
সামনে কল কল ছল ছল শব্দে বয়ে চলেছে বলেশ্বর নদী। নদীতে তেমন ঢেউ নেই, কিন্তু স্রোত আছে বেশ। নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মাছ ধরার নৌকো। ডান দিকে কিছু দূরে বরগুনা শহর ও বাঁ দিকে কিছুদূর গিয়ে নদী বাঁক নিয়ে সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে।
মনে পড়ল, নদীর পাড়ে এখানেই ছিল লঞ্চঘাট। ছোটবেলায় এখান থেকে লঞ্চে উঠে বরিশালে যেতাম। সময় লাগতো দশ বারো ঘণ্টা।
অমল আঙুল তুলে দেখালো, ওই যে দেখেন নদীর মাঝ বরাবর বড় একটা চরের মতন এলাকা, অনেক গাছপালা, বাড়ি ঘর দেখা যাইতেছে, ওইটাই মাঝের চর। চরের ওই পাশে নদী আছে, সিডরের পর নতুন কইরা গাছপালা জন্মাইছে। গাছপালা বড় হওয়ার জন্য ওই পাশের নদীটা এখান থিকা দেখা যাইতেছে না।
একটু থামে অমল, পরে আবার বলে,আমার কিন্তু সব মনে আছে, আপনে সেইবার সিডরের কয়দিন পর ক্ষয়ক্ষতির খবর নিতে এইদিকে আইছিলেন না! ঠিক কিনা?
এবার যেন পরিষ্কার মনে পড়ে গেল সব, সেদিন এক মাঝ বয়সী মহিলাকে ওখানে দেখেছিলাম আরো কয়েকজনের সাথে ওসে তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার কথা শুনে, সেদিন ওখান থেকেই তার সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম।
মনের ভিতরে হঠাৎ কি হলো কে জানে, অমলকে বললাম, চল তো, মাঝের চরে যাই’
অমল তো অবাক, সে কি, এখন যাইবেন আবার ওই চরে? চারিদিকের কি অবস্থা দেখছেন?
প্রচন্ড গরম, বৈরী আবহাওয়া, সব মিলিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ, কিন্তু এসব দেখেও কিসের টানে কে জানে, অমলকে একটা নৌকা ডাকতে বললাম। আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে অমল কি মনে করলো, কে জানে! তবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গজ গজ করতে করতে নদীর পাড় ঘেঁষে সামনে এগিয়ে গিয়ে কয়েক মিনিট পরে ছোট একটা নৌকা খুঁজে নিয়ে এলো।
মাঝির সঙ্গে দু’চারটা কথা বলে দুজনেই নৌকায় উঠলাম। মাঝিকে বললাম একটু তাড়াতাড়ি যেতে, কিন্তু প্রচন্ড স্রোতের কারণে সহজে এগোনো যাচ্ছিল না।
ফলে চড়ে পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। যখন মাঝের চরে এলাম তখন সূর্য একেবারে মাথার উপরে।
নৌকা ছেড়ে উপরে উঠে এসে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। মনের মধ্যে এই চরের পুরনো যে ছবিটা ছিল, তার সঙ্গে এখনকার চেহারাটা যেন ঠিক মিলাতে পারছিলাম না। কারণ সিডর হয়ে গেছে সেই প্রায় ১৫ বছর আগে। এই সময়ের মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে সবকিছুতে। তখন এখানে এত ঘর বাড়ি ছিল বলে মনে পড়ে না। বড় বড় গাছের চাইতে কলা গাছের সংখ্যাই ছিল যেন বেশি। এখন বেশ বড় বড় গাছপালা হয়েছে। কলা গাছ তেমন চোখে পড়ল না। নদী তীর থেকে গাছগাছালির আশপাশ দিয়ে ভেতরের দিকে চলে যাওয়া মাটির রাস্তাটা প্রায় তেমনি আছে, তবে কিছুটা যেন চওড়া মনে হল ওরাস্তার পাশ ঘেঁষে কিছু দোকানপাট বসেছে, ভালো ঘর বাড়িও উঠেছে কিছু। দুই একটা ঘরের পাশে গরু ছাগল রাখার ঘর তোলা হয়েছে দেখলাম।
দুপুর হয়ে যাবার কারণে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই ওমাথার উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ যেন আগুন ঢালছে। ছিঁটে ফোঁটা মেঘ দেখা যাচ্ছে না কোথাও ওমনে হচ্ছে, বৃষ্টি আসতে আরো কিছু সময় লাগবে।
রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে এসে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় বোকা মনে হলো। অমল কোন কথা বলছে না ও বুঝতে পারছি, মনে মনে সে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে আমার এই পাগলামি দেখে।
আসলেই তো তাই, কি কারনে আর কিসের টানে হঠাৎ করে এই সময়ে এখানে আসার সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম, কে জানে! এখন কোথায় পাব আমি সেই মহিলাকে? তার নামটাও তো এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না ও মরিয়ম, মর্জিনা নাকি ফাতেমা, এমনি ধরনের একটা নাম বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো কখনো কখনো স্মৃতিতে উঠে আসছে।
আর সেই কবে এখানে কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলাম, তাও তো ঠিক চিনতে পারছি না।
এবার অনন্যপায় হয়ে অমলের শরণাপন্ন হলাম। আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, এখানের কাউকে তুমি চেনো, অমল?
অমল একটু নরম হলো যেন বলল, বন্দরে যাওয়া আসা করে এমন দু-একজনের নাম জানি, কিন্তু এখানে কে কোথায় থাকে জানি না। তবে ওই বাদশারে তো চিনি।
একটু আগে যারে চায়ের দোকানে দেখলেন।
বাদশা! বাহ, নামটা তো চমৎকার ও বললাম, ওদের ঘরটা খুঁজে পাওয়া যাবে?
আপনে খারান, বলে অমল একটু দূরে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বয়স্ক মানুষের কাছে গিয়ে মিনিট দশেকের মতো কথাবার্তা বলে ফিরে এসে বলল, ওই বাঁ দিকের চার পাঁচটা ঘর পরে যে ঘরটার পাশে দুইটা কলা গাছ দেখতেছেন, সেই ঘরটা বাদশাদের।
সময় নষ্ট না করে গাছের ছায়ায় ছায়ায় আমরা চলে গেলাম বাদশাদের ঘরের দিকে। ঘরের সামনে গিয়ে ভেতরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলাম ভেতরে কেউ নেই।
ঘরের পিছনের দিকে পাকের ঘরে কেউ থাকতে পারে, অমল বলে ওঠে, দেইখা আসি’ বলে ঘরের বাইরে কলা গাছের পাশ দিয়ে সে পিছনের দিকে চলে গেল। বেশি সময় নিল না, কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভেতর দিয়েই আবার সামনে চলে এলো। পেছনে পেছনে এলো এক মহিলা। নেন কথা কন, এই হইল মর্জিনা ও বাদশার আম্মা।’
আমি তাকালাম মর্জিনার দিকে। বছর ১৫ আগে দেখা সেই মানুষটাই কি এই! মনে মনে সেদিনের সেই মর্জিনার সঙ্গে আজকের এই মর্জিনাকে মেলাবার চেষ্টা করি। কপালের ডানপাশে একটা কাটা দাগ ছিল যেন। লক্ষ্য করে দেখলাম, সেটাও আছে। ভাঙাচোরা শরীরে বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ও অযত্ন অবহেলা আর বয়সের ভারে কাহিল এক বৃদ্ধা যেন দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।
জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, একটা কথা বলতো, সিডরের সময় তুমি এখানে ছিলে?
মাথা কাত করে মর্জিনা, অর্থাৎ ছিল।
সেই দিন সন্ধ্যার পর সিডরের পানি তোমাকে এক টানে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এখান থেকে দশ পনেরো মাইল দূরে রামনার চরে? সেই চরে শেষ রাতে, একেবারে ভোরের দিকে তোমার জ্ঞান ফিরেছিল, সেই রকম ভয়ংকর ঘটনাই তো ঘটেছিল সেই দুর্যোগের রাতে?
প্রশ্নটা শুনে চোখের ভুরু কুঁচকে যায় মর্জিনার ও বলে, ঘটছিল তো, কিন্তু হেতে কি?
আমার কথা মনে পড়ে তোমার, আমার দিকে তাকাও? সিডরের তিনদিন পর তুমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বলেছিলে না কেমন করে ঐদিন সন্ধ্যায় প্রথমে প্রচুর গরম হাওয়া আসে, তারপর ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে, সেই সঙ্গে হঠাৎ করে দক্ষিণ দিক থেকে শো শো শব্দে বিরাট একটা জলের ঢেউ প্রচন্ড বেগে এই চরের উপর আছড়ে পড়ে। তারপর পলকের মধ্যে কেউ কিছু বোঝার আগেই চরের সব কিছু ডুবিয়ে দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন তোমার জ্ঞান ফিরে আসে একটা নদী তীরে, রামনার চরে ও এসব কথা মনে পড়ে?
এলোমেলোভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে কোন কথা না বলে শুধু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মর্জিনা। হয়তো সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করে।
এখন তুমি কেমন আছো, মর্জিনা? আমি আবার বলি, থাক এসব পুরোনো কথা।
কিন্তু এখন তোমার এই অবস্থা কেন? তোমার ছেলে বাদশা তখন ছোট ছিল, এখন তো বড় হয়েছে। শুনলাম বাদশা খুলনায় থাকে। ওর তো বাপও নেই, তুমি এখন ওর কাছে গিয়ে থাকো না কেন, তাহলে তো তোমার এত কষ্ট হয় না!’
প্রথমে বুঝিনি। আমার এই সমবেদনার ভাষাটুকু মর্জিনা কিভাবে নিল, সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরে।
‘অর লগে কি জন্য থাকুম, হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে মর্জিনা, ও তো সংসারের শনি, অর জন্যই তো অর বাপটা মরছে, আমি কেন মরলাম না, হায় হায়, আল্লায় আমারে কেন নিল না...?’
এইটুকু বলতে গিয়েই যেন একেবারে ভেঙে চুরে যায় মর্জিনা। দীর্ঘদিন ধরে বুকের ভেতরে জমে থাকা দুঃখ কষ্ট আর ক্ষোভ যেন একসঙ্গে উঠে আসে বিকট চিৎকারের মধ্য দিয়ে। কোটরাগত চোখ আর ভাঙাচোরা মুখমন্ডল ভেসে যায় চোখের জলে। ঠিকভাবে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না মর্জিনা। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে এক সময় দ্রুত ঘরের ভেতরে চলে যায়।