
প্রতীকী ছবি
আকাশের রাগী সূর্যটা মজিদ মিয়ার মাথার ওপর দাপিয়ে বেড়ায়। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। মাজায় পেঁচানো গামছা খুলে ঘাম মুছতে থাকে। বুকে জমাট বেঁধে থাকা ঘন-নিঃশ্বাসকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়। এতটুকু ক্লান্তি নেই। মুখে বিসমিল্লাহ বলে বাম হাতে লাঙ্গলের গুটি মাটিতে ঠেসে ধরে। বলদ দুটির শক্তি বাড়াতে হাঁক ছাড়ে। ‘আরে চল চল, হেই যা!’ এই বাক্যটি তার জীবন-জীবিকার সাথে মিশে আছে।
অন্যের জমিতে কামলা খেটে খেটে সময় ও শক্তি দুটোই শেষ হবার পথে। তবুও পূর্ব পুরুষের জীবিকার ধারা বদলাতে না পারার আপসোস তার রয়েই গেছে।
এ তল্লাটে মজিদ মিয়ার খুব কদর। সত্যিই হাতে জাদু আছে। তার চাষ দেয়া জমিতে ফসল ফলে দ্বিগুণ। নিজের এলাকা ছেড়ে সে কোথাও যায় না। এসব উঁচু জমিতে দীর্ঘদিন বন্যা না হবার কারণে মাটির উর্বরতা শক্তির হ্রাস পেয়েছে। আগের মতো ভাল পাট না ফলায় মালিকদের সে ধান রোপণের পরামর্শ দেয়। মজিদের কথায় মালিকেরা জমির সীমানা নির্ধারণ করে নতুন আল বাঁধে। স্যালো মেশিন বসায়। এসব জমিতে এখন প্রতিবছর কার্তিক সাইল, মধুসাইল, পরাঙ্গী ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে।
মজিদ মিয়া জমির আলের ওপর বসে বিশ্রাম নেয়। কপালে বাম হাতের চার আঙ্গুল ঠেকিয়ে সূর্যের গতিবিধি লক্ষ্য করে। সূর্যের অবস্থান দেখে সে সময় বুঝতে পারে। মাঠের অন্য চাষিরাও তার কাছে সময় জানতে দূর থেকে হাঁক ছাড়ে- ‘ও মজিদ ভাই,কতো বাজে?’
মজিদ মিয়া জগ উঁচু করে ঢক ঢক শব্দে পানি গিলে খায়। সে লক্ষ্য করে লাঙ্গলের জোয়াল টানতে টানতে দুটো গরুই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মজিদের পানি খাওয়া দেখে ওরা জিহ্বা চেটে তৃষ্ণার্ত হবার ইঙ্গিত দেয়। সামনে ডোবার পানির দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে। কিন্তু জোয়াল কাঁধে নিয়ে দু-কদমের বেশি এগোতে পারে না। মজিদ মিয়া বুঝতে পেরে জগের অবশিষ্ট পানি গরুর মুখ ফাঁক করে ঢেলে দেয়। সেই পানিতে ওদের গলা ভিজে মাত্র, কিন্তু তৃষ্ণা মেটে না।
চৈত্রের তাপে মাটি শুকিয়ে পাথর যেন! লাঙ্গলের তীক্ষ্ণ ফলা নরম মাটির তল খুঁজতে ভারি বেগ পেতে হয়। গরু নিজের কাঁধের ক্ষুদ্র জোয়ালকে পাহাড়সম ওজন মনে করে। লাঙ্গলের গুটি ঠেসে ধরতে ধরতে মজিদের কব্জি ব্যথা হয়ে আসে। তখন রাজ্যের রাগ ঢালে গরুর ওপর। ওদের আরও জোরে হাঁটার জন্য লেজে মোচড় দেয়। কঞ্চি দিয়ে আঘাত করে। মজিদ লক্ষ্য করে হালচাষের সময় বুড়ো গরুটা মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যায়। কখনো ধপাস শুয়ে পড়ে। চোখ বেয়ে জল ঝরে। সঙ্গীর সাথে মুখ ঘষে কথা বলে। এদিকে বেলা মাথার উপর থেকে হেলে পড়ে। এসব তামাশা দেখার সময় মজিদের নেই। দিন শেষে ওদের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় কাজের হিসেব মিলিয়ে নেয়াটাই তার কাজ।
মজিদের সংসারে সুখ আছে, অশান্তিও কম নেই। বিয়ের এত বছরেও সন্তানের মুখ তার দেখা হয়নি। সুখি বেগমের সারা শরীর তাবিজ-কবজ প্যাঁচানো। সকাল-সন্ধ্যা ফকির-কবিরাজ বাড়িতে লেগেই থাকে। মজিদের এসব বিষয়ে আগ্রহ কিংবা বিশ্বাস কোনটিই নেই। সে মেনেই নিয়েছে সন্তানের মুখ দেখার ভাগ্য তার নেই। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বৌকে ‘বাঁঝা-মাগী’বলে গালি-গালাজ করে। ঘরে দ্বিতীয় বউ আনার হুমকিও দেয়। ‘খালি দেহের জ্বালা মিটাইলি কি হবি, বংশ রক্ষা না হইলি কি দাম আছে পুরুষ মাইনষির জেবনে!’
সোয়ামির মুখের ওপর কথা বলার মেয়ে সুখি বেগম নয়। কোনোদিন প্রশ্ন করে দেখেনি কার দোষে পেটে সন্তান আসে না। তবুও দোষটা নিজের কপালের ওপর ছেড়ে সোয়ামির গাল-মন্দ নীরবে সহ্য করে। কারণ তার বিশ্বাস, বিধাতা ধৈর্যশীল মানুষকে পছন্দ করেন। মাঝে মাঝে বিছানা আলাদা হয়। আবার সোয়ামির ডাকে কাছে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই চলে সংসারের নতুন-পুরানো খেলা।
মজিদ মিয়া গরু গোয়ালে রেখে পিঁড়ি পেতে বারান্দায় বসে। বউকে কাছে ডাকে। কোনও সাড়া-শব্দ পায় না। দরজায় তালা ঝুলছে। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসে। রাগে সে গম গম করে। উঠোনে এসে চিৎকার করে সুখি বলে ডাকে। কোদাল দিয়ে তালা ভাঙ্গতে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে সুখি তড়িঘড়ি করে আঙ্গিনায় পা রাখে। আঁচলে গিট দিয়ে রাখা চাবি দিয়ে তালা খুলে। পানির জগ আর গামছা সোয়ামির হাতে দেয়। মজিদ মিয়া পানির জগ ছুঁড়ে ফেলে।
‘খবরদার, আমারে তুই ভুল কইরাও ছুঁবি না কইলাম। তুই আবার নষ্ট হইছিস! আগে ক’কার সাথে অকাম কইরা আসলি? কয় টাহা কামাই কইরা আনলি?’
‘নাউজুবিল্লাহ! এইডা তুমি কি কও মিয়া! আমার উপরে তোমার বিশ্বাস নাই?’
মজিদের বিশ্বাস অনেক আগেই ভেঙে গেছে। বিশ্বাসের গোপন ঘরে আগুন জ্বেলেছে সুখি নিজেই। গেল বছর হাসপাতালে ধুকে ধুকে মরতে বসেছিল মজিদ। সুখিই তাকে বাঁচিয়েছে। সেদিন মজিদ মিয়ার এপিন্টিসাইড অপারেশন না করলে তাকে বাঁচানো যেত না। সুখি স্বামীর চিকিৎসার জন্য হাঁস-মুরগী, পালানের শাক-সবজি এমন কি নিজের হাতে লাগানো গাছ বিক্রি করে। তাতেও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় টাকা গোছাতে পারে না। উপায় খুঁজে না পেয়ে অলি মেম্বরের কাছে পাঁচ হাজার টাকা ধার চায়। কিন্তু মেম্বর যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কানা-কড়িও কাউকে দেবার মানুষ নয়, সুখি তা ভাল করেই জানে। সেদিন ভরদুপুরে সুখি তার গোপন শর্তে রাজি হয়েই পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে হাসপাতালে জমা দেয়। স্বামীকে যে তার বাঁচাতেই হবে!
সুখি নিজের ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। স্বামীর অপারেশন শেষ হবার সাথে সাথেই সন্ধ্যার দিকে সে অলি মেম্বরের বাড়ি আসে। সহবাসের জন্য তার বিছানায় যেতে বাধ্য হয়। ঐদিন দুপুরে অলি তার বউ মমতাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। কিন্তু চোরের দশদিন হলেও গৃহস্থের জন্য যে একদিন বরাদ্দই থাকে। মমতা অপ্রত্যাশিতভাবে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসে। এসে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ। কানে ভেসে আসে সঙ্গমের শীৎকার। টিনের ছিদ্রে চোখ রেখে দেখে নিজের পেতে রাখা বিছানায় কোনও নারীর সাথে স্বামীর সঙ্গমের দৃশ্য। কিছুক্ষণ পরেই সুখিকে দ্রুত পায়ে চলে যেতে দেখে। মমতা সেদিন সোয়ামির মুখে থুতু ফেলে চিরতরে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে। সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছে যারা এমন রসাল ঘটনা আলোচনা করে মজা পায়। পাড়া-পড়শি থেকে শুরু করে বৌয়ের কু-কীর্তির খবর শেষ পর্যন্ত মজিদের কানেও আসে। সুখি নিজেও স্বামীর কাছে বিষয়টি গোপন রাখতে চায়নি। মজিদ মিয়ার মানতে কষ্ট হয় তার বউ কেন দেহ বিক্রি করে তাকে বাঁচাতে গেল! এর চেয়ে মৃত্যুই যে ভালো!
আবুবকর