ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

অকালপ্রয়াত এক লেখক

সরকার মাসুদ

প্রকাশিত: ১৮:২৬, ১৭ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ২১:২১, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

অকালপ্রয়াত এক লেখক

তারেক মাহমুদ (১৯৭১-২০২৪) বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত হয়েছিলেন কবি হিসেবে। ছোট গল্প ও আলোচনাধর্মী কিছু গদ্যও লিখেছেন। ‘পথিক’ নামে একটি সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ছিলেন। উপরন্তু ‘ছায়ালোক’ নামে তার একটি প্রকাশনীও ছিল। আমার প্রথম গল্পের বই ‘দূরবীনের ভিতর দিয়ে’-এর প্রকাশক ছিলেন তারেক।
এই কবি ও গদ্যকারের ছ’সাতটি কবিতার বই বেরিয়েছিল। আমার সংগ্রহে আছে দুটি- ১. সুবর্ণার চোখ ২. পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা। এই বই দুটোর ভিত্তিতেই তার কবিতার গুণাগুণ বিচার করতে বসেছি আজ। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।
১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে তারেক মাহমুদকে চিনতাম। ওই সময় আমাদের একটা নিয়মিত আড্ডা ছিল শাহবাগস্থ পিজি হাসপাতালের আমতলায় ও সংলগ্ন পাকা চত্বরে। আমার প্রজন্মের কবিদের মধ্যে রিফাত চৌধুরী, অমিতাভ পাল, জুয়েল মাজহার, রেজাউদ্দীন স্টালিন, মিজান রহমানসহ অনেকেই আসতেন। আসতেন কবি মাহবুব কবির, আশিক আকবর, গল্পকার ইচক দুয়েন্দে প্রমুখ। এখানেই পরিচয় হয় তারেক মাহমুদের সঙ্গে। তারেক তখন পাবনার অধ্যায় শেষ করে ঢাকায় নবাগত। দু’ তিন বছরের ভেতর তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঢাকা শহরের ৫-৬টি জায়গায় থেকেছেন। দুটি জায়গায় আমি গিয়েছিলাম, রাতে আশ্রয় নেয়ার জন্য। তার মধ্যে একটা ঘরের কথা মনে পড়ে। গ্রিন রোড সংলগ্ন কোনো এক মহল্লার একটা ছোট্ট রুমে উনি কিছুদিন ছিলেন। রুমটা এতই ছোট যে, কোনোমতে একটা সিঙ্গল চৌকি বসানো গেছে। ঘরে হাঁটার জায়গা একদমই নেই। জানালাও নেই। সেই রাতে আমার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে তারেক স্মিত হেসে বলেছিলেন, “কবরের মতো না?” আর আমি ভেবেছি, কতটা আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে থাকলে মানুষ এমন একটা ঘর ভাড়া নিতে পারে।
বিশুদ্ধ গদ্যে কবিতা লিখতেন তারেক। সেই গদ্য কখনো কখনো এতটাই গল্পঘেঁষা (তিনি গল্পও লিখতেন, সেজন্যই কি?) যে পাঠকের মনে হতে পারে, এ আবার কেমন কবিতা! কিন্তু সেটাই ছিল তার লেখার ধরন। অনেক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবিতায়, গ্রেট ব্রিটেনসহ ইউরোপের বহু দেশের কবিতায়, এমনকি আফ্রিকার আধুনিক কবিতায় গদ্যের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটছে। ওইসব কবিতার অনেকগুলোতেই গল্পের মেজাজও দেখা যাচ্ছে। এই তথ্য জানা থাকলে তারেক মাহমুদের কবিতায় গদ্যের সংক্রামকে অস্বাভাবিক মনে হবে না। যাহোক, আমি এবার তার কবিতায় প্রবেশ করব। দেখা যাক তিনি সেখানে কী বলছেন, কীভাবে বলছেন।
‘সুবর্ণার চোখ’ কাব্যে ‘কাউকেই মিস করতে চাই না শিরোনামে একটি কবিতা আছে যার প্রথম অংশ এমন- ‘ঘরের জানালাগুলো খুলে দাও- মশারা আসুক/মশাদের সাথে অতিথি হয়ে কিছু বাতাসও আসুক/মশার ভয়ে কেন জানালা বন্ধ করে বাতাসকে রুদ্ধ করো?” এবার রচনাটির শেষ পাঁচ পঙক্তি পড়ুন- ‘ব্যাঙ এবং প্রাপকেও নিমন্ত্রণ জানাতে পারো/আরো যদি পারো/একপাল ধেড়ে ইঁদুরকে খবর দাও/আর কে কে বাদ পড়লো তালিকা করো/আমার জন্মদিনে কাউকেই মিস করতে চাই না।” বলবার এই ভঙি পাঠককে মজা দেয়। কিন্তু আনন্দপ্রদতাই এর শেষ কথা নয়। ব্যক্তিমনের বিশেষ মুহূর্তের আবেগ বিশিষ্টভঙ্গিতে ধরা পড়েছে এখানে। কবি হৃদয়ের ঔদার্য এই কবিতার থিম। এর সারল্যচিহ্নিত প্রকাশভঙ্গিটি মনে দাগ কাটে।
“এইসব ভালো লাগে না- বুঝলে-একদম”...এমন আলাপচারিতার স্টাইলে শুরু হয়েছে ‘ব্লেড শেভ এবং চুম্বন বিষয়ক জটিলতা’ কবিতাটি। কবিতার মাঝখানে লেখক বলছেন, “ধারালো অস্ত্রের ছোবলে অপ্রস্তুত প্রতিদিন/প্রতিরাতে মসৃণতা দান করতে করতে/আমার ত্বক ক্রমশ হয়ে উঠছে কঠোরতর/একদিন তা হয়তো ইস্পাত কঠিন হয়ে যাবে/ততদিনে তোমার ওষ্ঠদ্বয় হয়ে যাবে মরা গাঙ।” পাঠক, এই স্তবকের ‘অপ্রস্তুত প্রতিদিন’ শব্দবন্ধটি লক্ষ্য করুন। এর ভেতর দিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের বিরক্তি ও বিষাদ বাণীরূপ পেয়েছে। এবং ‘ততদিনে’ শব্দটি প্রতীক্ষারত প্রিয়তমার ইঙ্গিতবহ। রুটিনক্লান্ত নগরজীবনের নির্বেদী প্রাত্যহিকতা রোমান্টিক কবিমনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে তার একটা চিত্র উপহার দিয়েছে এই কবিতা। লেখাটি শেষ হয়েছে এভাবে- “তোমার ওষ্ঠদ্বয় আমাকে মুক্তি দেবে একদিন/আমিও রেহাই পাবো/ব্লেড আর শেভ-এর যন্ত্রণা থেকে।”
শ্লেষকে উপজীব্য করে তারেক মাহমুদ একাধিক সফল কবিতা লিখতে পেরেছিলেন। সে রকম একটি কবিতা হচ্ছে পুষ্টিহীনতা অর্থাৎ রোগা হওয়া অর্থাৎ স্লিম হওয়া অর্থাৎ আধুনিক জীবন। দেখুন, শরীরের পুষ্টিহীনতাকে লেখক বিদ্রƒপের শরে বিদ্ধ করেছেন কীভাবে-“পুষ্টিহীন জীবনের অর্থ রোগা হওয়া/আর রোগা হওয়ার অর্থ স্লিম হওয়া/আর স্লিম মানে আধুনিক জীবন!”
তারেকের কবিতার একটি প্রধান সুর রোমান্টিক অনুভব ও আকুতি। প্রেম-ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই উচ্ছ্বাস সামলাতে পারেননি, হয়ে উঠেছেন অতিভাষী কিন্তু ‘রিমা বরাবর’ তার অল্প কিছু কবিতার মধ্যে অন্যতম যেখানে আবেগ যথেষ্ট সংহত এবং উচ্চারণ আবেশযুক্ত ও ইঙ্গিতময়- “সমুদ্রের ঢেউ/প্রজাপতির উড়ে যাওয়া/বিকেলের ম্লান আলোয় হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো/একটি গোলাপের শব্দে তার কণ্ঠ শুনেছি।” আমি আরও খুশি হতাম যদি ‘গোলাপের’ পরে ‘শব্দে’ ব্যবহার না করে তিনি ‘ঠোঁটে’ লিখতেন। তার অনেক লেখা গন্তব্যহীনতার দোষে দুষ্ট। বেশ কিছু পঙক্তি ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে- “সেই দূর্বা ঘাসের বয়স তখন/একটুখানি ছোঁয়াতেই নুয়ে পড়ি/দাগ দিয়ে যায়/সেই দাগ কোলের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি/বিড়াল ছানার মতো।” (জয়াকে মনে পড়ছে)।
‘পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা’র অধিকাংশ কবিতা আগের মতোই আবেগী উৎসারণের দৃষ্টান্ত। ফলে সেগুলো যোগাযোগসক্ষম- “আমার কাঁধে প্রিয়তমার কফিন/কফিনে সাদা কাফনে শুয়ে আছে আমার রঙিন ভালোবাসা।? তারেকের কবিতায় ভালোবাসা-মিলন-বিচ্ছেদ-এর অভিব্যক্ত স্বচ্ছ, অকপট ও প্রায়শই সরাসরি। ক্ষেত্র বিশেষে প্রতীক বা ইঙ্গিতের প্রয়োগ যথাযথ। সব মিলিয়ে চিন্তা করলে তারেক মাহমুদকে প্রেমের কবি আখ্যা দেয়া যায়। শব্দ প্রয়োগের বেলায়, কবিতাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এবং আরও কিছু বিষয়ে তার অনেক ত্রুটি আছে। আবার এও ঠিক যে, তারেকের কবি কল্পনা ভাবনায় ভিন্নতাও আছে। এই লেখক অনুভব করেছেন, “নতুন ধারণার রঙ অন্যরকম।” অন্য এক কবিতায় তিনি বলেছেন “মেয়েটি কাঁদছে/পার্কটিকে তাই ব্যর্থ মনে হচ্ছে,” কেননা তার মতে “পার্কে তো কেউ কাঁদে না।”
সহজবোধ্য ভাষা ও সাবলীল প্রকাশভঙ্গি তারেক মাহমুদের কবিতার ইতিবাচক দিক। তাছাড়া কবিতায় প্রযুক্ত গদ্যে গল্পের ভঙি প্রয়োগ করেও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা সম্ভব। তা তিনি ‘গফুর স্যার’ শিরোনামের কবিতাটির মাধ্যমে দেখিয়েছেন। কখনো কখনো দার্শনিকসুলভ ভাবনা ও জিজ্ঞাসা এসেছে তার কাব্যে, শিল্পের সুষমা সঙ্গে নিয়েই- “মানুষ কি সংগঠিত নাকি একা/তুমুল বৃষ্টি ঝরছে- বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে গাঙের পানিতে/পানি আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে-/আঘাতপ্রাপ্ত পানি থেকে সৃষ্টি হচ্ছে শব্দ/এই শব্দ কিসের প্রতীক/শুদ্ধতার, ঘুমানোর নাকি জেগে উঠবার?”
অনেক বছর আগে, কোন কবিতায় মনে নেই, তারেক লিখেছিলেন ‘পাহাড়গুলো পৃথিবীর পেপারওয়েট”। পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এমন যার পরিকল্পনা আর এত স্বচ্ছ যার কাব্যভাষা তার তো বহুদূর এগোনোর কথা ছিল। তা হয়নি, কেননা যথেষ্ট সময় তিনি ব্যয় করতে পারেননি কবিতার পেছনে। জীবনের একটা পর্বে, শেষের দিকে, তিনি টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন। সহজাত অভিনয় প্রতিভা ছিল তার। বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ও করেন। ‘চটপটি’ নামে একটি ছবি তৈরি করছেন, পয়সার অভাবে কাজটা শেষ করে উঠতে পারছেন না; এরকম শুনতাম লোকমুখে। শেষের কয়েক বছরে তারেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ওই সময় তিনি আড্ডা দিতেন শিল্পকলা একাডেমিতে। কবি, অভিনেতা, নাকি নির্মাতা- কোন পরিচয়ে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছেন তারেক? এ প্রশ্ন মাথায় এসেছিল। উত্তর পাইনি। সব জিজ্ঞাসা ও জটিলতার ঊর্ধ্বে চলে  গেছেন তিনি।

প্যানেল

×