ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলা নববর্ষ

কালের আয়নায়

সাইফুজ্জামান

প্রকাশিত: ১৭:৩৬, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

কালের আয়নায়

আবার ফিরে এসেছে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মূল শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মুহূর্তে জীবনাচরণ, বিশ্বাস, উৎস মুখে বিরাজিত বীক্ষণ থেকে বাঙালিত্ব পুনরুদ্ধারে প্রতিবছর একবার হলেও উপলব্ধির সরোবরে অবগাহিত হয় এ কম কী? আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়ন, জীবনব্যবস্থা ও প্রতিদিন যাপিত দিনে নানা ব্যস্ততার মধ্যে নববর্ষ উদযাপনের কর্মযজ্ঞে শেকড়লগ্ন হওয়ায় টান অনুভব করে বাঙালি প্রতিনিয়ত।
 প্রাচীন জনপদ খনন, লেখামালা, শিলালিপির মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস অল্প কিছু জানা যায়। চতুর্দশ শতকে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ শাহ-ই- বাঙালিয়া বা বাঙালিদের বাদশা বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। সুলতানি আমলে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ বেদ, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত অনুবাদে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী অবধি আরবীয় বণিকগণ বাংলায় আগমন করলে আরবী-বাংলা সংমিশ্রণে সংস্কৃতি পুষ্ট হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতকে মুঘল মহামতি আকবর বাংলা দখল করলে বাংলাভাষা, সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। জনশ্রুতি আছে আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ তথ্য সঠিক না হলেও বলা যায় আকবর ইলাহী সন প্রবর্তন করেন। ইলাহী সনের পথ ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়।
ইংরেজ শাসনামলে রবীন্দ্র পরিবারে শান্তি নিকেতনে বাংলা নববর্ষ আয়োজনের সূত্রপাত ঘটেছিল। মোঘল শাসকেরা ইরানের নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিলিত হতো। মিনাবাজার আয়োজনে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। মুর্শিদকুলী খান, আলীবর্দী খাঁ, বেড়াভাসান, জমিদারদের পুণ্যাহ ও হালখাতা আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করা হতো। হিজরি সন গণনা চাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্রাট আকবরের সময় জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরসন এবং হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা সন’ গণনা শুরু করেন। ১৮৫৪ সালের ১০ মার্চ, মতান্তরে ১১ মার্চ বাংলাসন গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ সনের ৫ নভেম্বর । বাংলাসন গণনা কার্যকর শুরু হয় প্রথমে ফসলি সন, বঙ্গাব্দ ও বাংলা নববর্ষ নামে। চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা পরিশোধ হতো। ১ বৈশাখ ভূমির মালিকেরা প্রতিবেশীদের মাঝে মিষ্টান্ন বিতরণ করত। ক্রমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। হালখাতা আয়োজন উল্লেখযোগ্য। এ সময় নতুন খাতায় হিসাব-নিকাশ লিপিবদ্ধ করে রাখার রেওয়াজ দেখতে পাওয়া যায়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ শাসকদের বিজয় কীর্তন করে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হতো। ১৯৬৭ সাল থেকে নববর্ষ উৎসব আয়োজন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ক্রমে পূর্ব বঙ্গে বাঙালি জীবনাচরণে নববর্ষ উদযাপন উল্লেখযোগ্য উৎসবে পরিণত হয়। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কিষানী নতুন ঘটে আতপ চালের সঙ্গে আম গাছের কচি নতুন পাতা যুক্ত ডাল ভিজিয়ে রাখত, পরের দিন ঘরের চারপাশে পানি ছিটানো হতো। নববর্ষ উপলক্ষে মেলা, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়া বান্ধা, হাডুডু, লাঠিখেলা, মোরগ লড়াই, জারিসারি গান, পুতুল নাচ ও সার্কাসের ব্যবস্থা করা হতো।
উৎসব শুরু হতো বৈশাখ মাসের ১ তারিখ থেকে। পুণ্যাহ ছিল রাজস্ব আদায়ের জন্য বার্ষিক বন্দ্যোবস্ত উৎসব। প্রাক ব্রিটিশ আমলে সরকার জমিদার তালুকদার ইজারাদারদের থেকে বছরের নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব আদায় করে নিত। এ ব্যবস্থাকে পুন্যাহ বলা হতো। এ ব্যবস্থায় পূর্ববর্তী বছর ও নতুন বছরের রাজস্ব উত্তোলন করা হতো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় ১৯৫০ সাল থেকে পুন্যাহ উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। ’৪৭-এর দেশভাগের পর  পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলিত বাঙালি আত্মনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে। ষাট দশকে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন ও চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়।
‘ছায়ানট’ পঞ্চাশ দশক থেকে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা ও নববর্ষ উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ক্রমান্বয়ে সম্মিলিতভাবে নববর্ষ উদযাপন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।  বিভিন্ন সংগঠন একত্রে ও পৃথকভাবে  নববর্ষ উৎসব আয়োজন করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নববর্ষ নানা আঙ্গিকে পালিত হচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নববর্ষে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। নববর্ষে বাড়ি-ঘর-আঙ্গিনা পরিষ্কার করা হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। মেলা আয়োজন করা হয় ও সে মেলায় হস্ত ও কুটির শিল্পের বিকিকিনি চলে। এসব মেলায় লোকসংগীত পরিবেশনা ও সার্কাস, নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। বিভিন্ন রঙিন মুখোশ ও প্রাণীর প্রতিকৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্থান পায়। ১৯৮৯ সাল থেকে  মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা নববর্ষ আবাহনের মাধ্যমে বর্ষবরণ করে থাকেন। সাদাশাড়ি লালপাঁড় পরিহিত রমণীদের কলকাকলিতে রমনা সেদিন মুখর হয়ে ওঠে। পুরুষসঙ্গী সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি শিশু-পুত্র-কন্যারা রঙিন পোশাকে সজ্জিত হয়। পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম লেগে যায়। রকমারি ফুল-বেলুন ও খাওয়ার মধ্যে বাঙালি উৎসবে প্রত্যাবর্তন করে। সোনারগাঁওতে বউমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলা বটতলার মেলা নামে অধিক পরিচিত। বটবৃক্ষের নিচে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা করতেন। কুমারী, নববধূ ও নারীরা তাদের মনবাসনা পূরণের জন্য পূজা করতেন। সন্দেশ, মিষ্টি, ধান দূর্বা, ফলমূল পূজার অর্ঘ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। শান্তির জন্য কপোত-কপোতি পায়রা উড়ানো হতো। একশত বছরের পুরনো মেলা আজও আদৃত। সোনারগাঁ থানার পেরবা গ্রামে ‘ঘোড়া মেলা’ অনুষ্ঠিত হতো। জনশ্রুতি আছে জামিনি সাধক ঘোড়ার আরোহণ করে নববর্ষে প্রসাদ বিতরণ করতেন। তার মৃত্যুর পর স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঘোড়া স্থাপন করেই সে মেলার সূচনা করতেন। এই মেলায় নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হতো। সবশ্রেণির মানুষেরা কলাপাতায় খিঁচুড়ি প্রসাদ গ্রহণ করে খেতেন।
চট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্কে নববর্ষ উৎসব আয়োজন করা হয়। ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে ইস্পহানি পাহাড়ের পাদদেশে নববর্ষ উপলক্ষে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বর্তমানে তা বিস্তৃত হয়ে সি, আর, বি এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। নববর্ষ উপলক্ষে পার্বত্য  চট্টগ্রাম এলাকায় ত্রিপুরাদের  বৈশুখ মারমা সাংগ্রাই ও চাকমা বিজু উৎসব পালিত হয়। মারমাদের পানি উৎসব প্রসিদ্ধ।
উংরেজী মাধ্যমে লেখাপড়া করা তরুণ প্রজন্মের কাছে নববর্ষ কতটুকু গ্রহণীয় হচ্ছে প্রশ্ন উঠতে পারে। ডিশ এন্টেনা, ইন্টারনেটের অবাধ অনুপ্রবেশের সময় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটেছে সত্য কিন্তু বাঙালিয়ানা ধরে রাখতে না পারলে সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।

×