ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১

ছোট গল্পঃ ছুটির ঘন্টা

মাহবুব হাসান বাবর 

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ১২ এপ্রিল ২০২৫

ছোট গল্পঃ ছুটির ঘন্টা

নবনীর সাথে দেখা হলো তেরোবছর পর। সাথে ফুটফুটে একটা মেয়ে বাচ্চা। নবনীর মুখটায় কেমন দুঃশ্চিতার ছাপ। আমাকে দেখে ভীত সন্ত্রস্ত বালকের মতো তাকিয়ে ভ্রু কুচকালো। চিনতে পেরেছে কিনা জানিনা। আমি ডাকলাম-
ঃ নবনী- নবনী
আমার ডাক শুনে নবনী আমার দিকে তাকালো। আমি কাছে যেতে বললাম
ঃ কেমন আছো?
নবনী মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে আছে। খুব সন্তর্পণে উত্তর দিলো
ঃ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
নিজের কাছে কেমন যেনো লাগলো।  নবনীতো কখনও আপনি বলেনি।
তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
ঃ চেহারার এ কি হাল হয়েছে তোমার। এতোদিন পর কোথা থেকে আসলে। এতোদিন কোথায়ইবা  ছিলে?
আমি নবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি- কোনো কথা বলতে পারছিনা। ইচ্ছে করছে দুই হাত দিয়ে নবনীর মুখটা একটু ধরি।
ওদিকে নবনীর ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি তার হাত ধরে টানতে টানতে পাশে থাকা চেয়ারে টানতে টানতে  নিয়ে বসলো।

অনকোলোজি ডিপার্টমেন্টের সামনে বসে আছি আমি  আর নবনী বসে আছে ডায়ালোসিস রুমের সামনে।
বারবার চোখ যেযে নবনীর চোখে আটকে যাচ্ছে- নবনীরও তাই। বুকের ভেতরটা হুহু করছে।

নবনীর সাথে শেষ দেখার দিন আত্মীয় স্বজন আর পরিবারের সেই বিভৎসদৃশ্য আজও মনে আছে। ওরা নবনীকে আমার কাছ থেকে  কেড়ে নিয়ে গেলো।
নবনী আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চলে যেতে যেতে পিছনে তাকালো। তখন আমার  চোখের পানি ঝরে ঝরে পড়ছে শুন্যতায়।
নবনী আমার কাছে ধীরে ধীরে এসে বললো
ভালো থেকো রুদ্র। শরীরের যত্ন নিও। এইপারেতো তোমাকে পেলাম না- পরপারে যেনো পাই। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ছোটোমামার সাথে চলে গেলো। আমি তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে অদৃশ্য হলো সে।
নবনীকে ওরা কেড়ে নিয়ে গেলো। কেড়ে নিয়ে কানাডায় সেটেল্ড একজনের হ্তে তুলে দিলো। বিদেশ বিভূঁইয়ে লাল নীল স্বপ্নের মতো আমিও হয়তো হারিয়ে গেলাম তার হৃদপিণ্ডের ভেতর বাহির থেকে। নবনীকে ভেবে ভেবে আর কোনোদিন কারো দিকে তাকাতে পারিনি। একাকীত্ব নিয়েই কেটে যাচ্ছে পয়ত্রিশ বছর। নবনীর মতো কেউ আমাকে আর ভেঙ্গেচুরে ভালোবাসতে পারেনি। 
দুঃসম্পর্কের এক খালা আমায় ভালোবেসেছিলো আমায়। কিন্তু আমি বাসতে পারিনি। তার ভালোবাসায় হয়তো খাঁদ ছিলোনা। খাঁদ ছিলো আমার ভালোবাসায়। কারন নবনীর জায়গায় আমি কাওকে বসাতে পারবোনা কোনোদিন। তাই আজও আমি উদভ্রান্ত - আজও নবনী আমার সকাল দুপুর রাত্রী। আজও নবনী আমার অস্থি মজ্জা থেকে শুরু করে আপাদমস্তক।  
নীল খালা আমার প্রেমে পড়েছিলো। সেও একসময় প্রবাস ছেলের সাথে দেশ ছাড়ে। অনেকগুলো নীল খাম পাঠিয়েছিলো আমাকে। আমি সযত্নে লেখা চিঠির একটি উত্তর লিখেছিলাম

নীল খালা 
তুই এখন কেমন আছিস?
তোদের ওখানেও কি ঘোর অমাবশ্যা নেমেছে?
তোর কি মনে আছে ঘুড়ি উড়ানো দিনগুলির কথা!
তোর কি মনে আছে জানালা দিয়ে  বুকের ভেতরে গোঁজা চিঠিখানা ছুড়ে মারবার কথা!
মনে আছে- নাকি একেবারেই ভুলেছিসরে!
আজ একটুও ভালো নেই- ভালো নেই আমার স্মৃতিগুলোও। আমার নবনীর জায়গায় আমি কাওকে বসাতে পারিনিরে। যেমন পারিনি তোকেও। তাই আমাকে ক্ষমা করিসরে। আমি বড় স্বার্থপর।  কারন নবনী ছাড়া আমার আর কাওকে কোনোদিন দরকার হবেনারে।
তারপর দেখিস-
একদিন ঘোর বৃষ্টিতে মুছে যাবে সব স্মৃতিচিহ্ন। নবনী আমার কবরের কাছে এসে চিৎকার করে কাঁদবে। কবরের মাটি হাতড়াবে।আমার নামের শব্দে মুখরিত হবে। হয়তো তোর মনের ভেতরেও হবে আমাকে নিয়ে উৎসব।
নীল খালা, তোর ওখানে কি এখনও রোজ সকালে কুয়াশা নামে!
আমার এখন গ্রীস্মকাল
এই ঋতুতেও এখনও কুয়াশা নামে।
আজও আমার হাতের মুঠোয় আসেনি তোর মতো প্লেটো- এরিস্টটল।
কিংবা সক্রেটিস- আর্কিমডিস।
আমার হাতে আছে সায়ানাইড- নবনীর জন্যই তা- ই উৎসর্গ করবো।
নীল খালা, তোর কি মনে আছে তুই একবার বুকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলি। তুই বলতি আমি নাকি তোর ভরা পূর্নিমা। কিন্তু তোর কাছে আমি এখন ঘোর অমাবশ্যা। আমি নাকি তোর জোনাক জ্বলা রাত হতে চেয়েছিলাম। তা আর হতে পারলাম কই! তোর লেখা গল্প হয়েই থাকলাম আজন্ম। আমার অন্তর বাহির জুড়ে কেবলই নবনী। নবনী আমার পুরো পৃথিবী। নবনী আমার আত্মার নাম। 
নীল খালা আর লিখবোনা তোকে। সম্ভব হলে আমাকে লিখিস। আর না চাইলে দরকার নেই।
কত যুগ-যুগান্তরইতো কাটলো। বাকী দিনগুলি কোন না কোনভাবে কেটেই যাবে।
নীল প্রেসারটা কন্ট্রোলে রাখিস- ঠিকমতো ওষুধটা খেয়ে নিস।
ভালো থাকিসরে নীল
|||
রুদ্র

চিঠিটা লিখে কুচিকুচি করে ছিড়ে শুন্যে ফেলে দিলাম।

আজ এতোবছর পর নবনীর দেখা পেলাম। কিন্তু খটকা লাগলো কানাডা সেটেল্ড নবনী এখানেইবা কেন?
নবনীর সাথে মোটা গোফওয়ালা একজন বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে পাশের চেয়ার থেকে।
মাথা নিচু করে আছে নবনী। ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি এখন ঐ লোকটার কোলে।
কলিংবেল বেজে ওঠলো। অনকোলজির ডাক্তারের এসিসট্যান্ট ডাকছে আমার নাম ধরে। মন ভারী করে চেম্বারে ঢুকলাম।
 কেমো থেরাপির সব আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ডাক্তার। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। আমার কানে কিছুই ঢুকছেনা। আমার মনের ভেতর নবনীর মুখর ডাক। চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে দেখি নবনীরা নেই।
মন ভারী করে বেরোনোর সময় ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন আর হাতের টেস্টের  সমস্ত কাগজ ছিড়ে ফেললাম। অনেকেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।  কেউ কেউ কী যেনো বিড়বিড় করে বলছে। আমি কিছুই তা শুনতে পাইনি।
আমার হাতটা এখন ফাঁকা। আমি ভারহীন হাত নিয়ে হেটে যাচ্ছি চেনাপথ ছেড়ে অচেনাপথে। তখন এশার আজান হচ্ছে।
আকাশে বিশাল এক চাঁদ ঠিক যেনো নবনীর অবয়ব। আমি চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।  তারপর হাটতে হাটতে আমি চলে গেলাম মায়ের কবরের পাশে। 


মাহবুব হাসান বাবর
গল্পকার, আবৃত্তিকার - উপস্থাপক 
(মঞ্চ ও টেলিভিশন)
বিভাগীয় প্রধান (সমাজবিজ্ঞান বিভাগ)
সরকারি মুকসুদপুর কলেজ,
মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ। 

 

রাজু

×