
অনেক বীর ও বীরাঙ্গনার ত্যাগে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। কোনো কালেই কোনো দেশে স্বাধীনতা বিনা চেষ্টায় বা বিনা ত্যাগে আসেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে আবার হয়েছেন পঙ্গু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা এমনি একজন বীরশ্রেষ্ঠ’র গল্প আজ আমি তোমাদের শোনাব। তিনি ১৯৭১ সালের শেষদিকে সদ্য গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গানবোট পলাশের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মো. রুহুল আমিন।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালের জুন মাসে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বাঘপাচরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী এবং মাতার নাম জোলেখা খাতুন। কিন্তু পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি হাইস্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। করাচির অদূরে আরব সাগরে অবস্থিত পিএনএস বাহাদুরে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। পরবর্তী কর্মজীবনে তিনি ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি চট্টগ্রামে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ঘাঁটি পিএনএস বখতিয়ারে কর্মরত ছিলেন। পরে নৌঘাঁটি থেকে পালিয়ে তিনি মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ২নং সেক্টরে স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের শেষদিকে ভারত থেকে প্রাপ্ত দুটি গানবোট পদ্মা ও পলাশ দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠিত হলে তিনি পলাশের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার পদে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে যশোর সেনানিবাসের পতন হলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পদ্মা ও পলাশ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর প্যানভেল গানবোট তিনটি ৭ ডিসেম্বর মোংলা থেকে রওনা দেয় পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে নিয়ে। রূপসা নদীতে গানবোট তিনটির যাত্রাকরে রূপসা ফেরিঘাটের কাছে আসতেই আকাশে উড়ে আসে তিনটি জঙ্গী বিমান। রুহুল আমিনসহ কয়েকজন বাঙালি নৌসেনা জঙ্গি বিমান তিনটিকে বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে গুলি করতে চাইলেন। কিন্তু প্যানভেলের ভারতীয় কমান্ডার জানালেন যে ঐ বিমানগুলো ভারতীয়। তিনি গুলি করার অনুমতি দিলেন না। হঠাৎ জঙ্গি বিমানগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়ে এসে প্রথমে পদ্মা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পলাশের ওপর বোমাবর্ষণ করে। ভারতীয় কমান্ডারের নির্দেশে অনেক নৌসেনা যুদ্ধ না করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করেন। কিন্তু ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মো. রুহুল আমিন কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে এই বিমান হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু বোমা বর্ষণে ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে গেলে তিনি আহত অবস্থায় রূপসা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনোক্রমে নদীর পূর্ব পাড়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানেও তার জন্য অপেক্ষা করছিলো দুর্ভাগ্য। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান সেনারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন বাংলাদেশকে ভালোবেসে, এ দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেছেন। তিনি যে স্বাধীন, সার্বভৌম, জনকল্যাণকর ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্ম-বিসর্জন করেছেন, আমরা যেন সেই লক্ষ্যটি ভুলে না যাই। ভুলে না যাই বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনসহ নাম জানা ও না জানা সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।