ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

রাশি রাশি ঈদের খুশি

আশতাব হোসেন

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ২১ মার্চ ২০২৫

রাশি রাশি ঈদের খুশি

জাফরুল আর অসির দুই বন্ধু। তারা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। দু’জনেই খুব ভালো ছাত্র। তাদের মধ্যে খুব প্রতিযোগিতা হয় লেখাপড়া নিয়ে। কেউ হাল ছাড়বার পাত্র নয়। শুধু লেখাপড়াতেই নয় আচার-আচরণেও তারা খুব ভালো। তাদের গুণের প্রশংসা সকল শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের মুখেমুখে। তারা একজনকে ছাড়া অন্যজন চলে না। খেলাধুলাও দু’জন একসাথেই করে। কিন্তু একটা বিষয়ে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব। জাফরুলের বাবা সরকারি কর্মকর্তা। অন্যদিকে অসির বাবা দরিদ্র, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। তাই অন্য সব বাবাদের মতো ছেলে-মেয়েদের জামাকাপড় এবং পড়ালেখার খরচাপাতি বহন করতে পারে না।
আর্থিক অনটনের কারণে অসি ঠিকমতো পোশাক তৈরি করে পরতেও পারে না। সাথের বন্ধুরা নতুন নতুন পোশাক পরে আর অসি তাদের পোশাকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার মনের আকাশে যেনো মেঘ জমেই থাকে।
ক’দিন পরেই ঈদ। অসির বাবা অনেক চিন্তিত, কেমনে ঈদের বাজার সওদা করবে, রোজার দিনে তেমন ভ্যান চালানো সম্ভব হয় না রোজা থেকে। এদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে যা আয় রোজগার হয় তা দিয়ে পেটের খাবারই জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। ঈদের মধ্যে তো ছেলে-মেয়েকে নতুন একখান করে জামা দিতেই হয়, এক বছর হলো তাদের নতুন পোশাক দিতে পারেনি। ঈদের মধ্যে দেয়া হবে এই আশা দিয়ে রেখেছে। এসব ভাবনায় অসিরের বাবা খুবই অস্থির হয়ে উঠছে। অসিরও আশায় আছে ঈদের আগে তার বাবা নতুন পোশাক কিনে দিবে এজন্য মনের ভিতরে তার নীরব খুশির বাতাস বইছে। খুশিতে সে মাঝে মাঝে তার বাবার অনেক কাজের সহযোগিতাও করে চলছে।
ঈদের আর মাত্র দু’দিন বাকি আছে। অসির নতুন পোশাক কেনার খবর নেই। সে তার বাবাকে বলছে বাবা কবে কিনে দিবে আমার নতুন পোশাক? বাবা মনে কষ্ট নিয়ে বলে দেখি বাবা কী করা যায়। এই বলে সে কষ্টের বোঝা বুকের মধ্যে বয়ে চলে। জাফরুলের নতুন পোশাকের অভাব নেই, আর থাকবেই বা কেনো! বাবা সরকারি চাকরিজীবী, সংসারের অবস্থাও অনেক ভালো। কোনো কিছুর অভাব নেই তাদের।
সব সত্ত্বেও জাফরুলের মনে কোনো অহংকার নেই। সে ইফতারের আগে অসিরকে বাসায় ডেকে এনে বলছে, ‘অসির আজ তুই আমাদের বাসায় ইফতার করে যাবি।’
অসির সংকোচ বোধ করে বলে, ‘না না,  আমি বাড়ি গিয়েই ইফতার করব। তুই কি জন্য ডেকেছিস ঝটপট বলে ফেল দেখি।’ জাফরুল বেদরকারি কথা বলে শুধু সময় পার করছে যাতে ইফতারের সময় হয়ে আসে। এদিকে জাফরুলের মা চটজলদি বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে নানা পদের ইফতার তৈরি করছে। জাফরুলের মা-বাবা ও অসিরকে খুব আদর করে ভালো ও মেধাবী ছেলে হিসেবে।
‘ঈদ তো এসেই গেলো তবে ঈদের জন্য কি তোর বাবা নতুন পোশাক কিনে দিয়েছে?’ বললো জাফরুল।
অসির হতাশা চেপে কষ্ট নিয়েই উত্তর দেয়, ‘না রে, গরীবের ঈদের চাঁদ সবসময় মেঘেই ঢাকা থাকে! বাবা কিনে দিবে বলেছেন। তবে না দিলেও কষ্ট নেই।’ এই বলে এক ঝলক কষ্টমাখা হাসি অসিরের সামনের দাঁতের উপরে ফোটে। জাফরুল বুঝতে পারে এটা তার অন্তরের হাসি নয়। দায়সারা হাসি মাত্র। যাক সে তো তার বাবা-মা’য়ের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেই অসিরকে বাসায় ডেকে এনেছে। ইফতার করেই জাফরুলের বাবা-মাসহ অসিরকে সাথে নিয়ে বাজারে গিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। ইফতার করে জাফরুলের বাবা বলে অসির চলো তো বাজারে যাই আমাদের একটু বাজার করার কাজ আছে, তুমি একটু সাথে থাকলে ভালো হয়। বাজারের কাজ শেষ করে আমি নিজেই তোমাকে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। আর কাল চাল ডাল অনেক কিছু কিনতে হবে সে জন্য তোমার বাবার ভ্যান গাড়িটাও নিয়ে আসতে বলব। অসির মাথা নিচু করে রাজি হয়ে তাদের সাথে বাজারের যায়।
জাফরুলের বাবা ইমরান সাহেব পোশাক দেখতে শুরু করে। একই রঙের দু’টো পাঞ্জাবি দেখে ইমরান সাহেব। অসির মনে মনে বুঝতে পারে জাফরুলের বাবা হয়তো তাদের দুজনের জন্যই পছন্দ করেছেন। অসিরের মনে খুশির ঢেউ বইতে শুরু করেছে। জাফরুলের বাবা ইমরান সাহেব পাঞ্জাবি-পায়জামা, চামড়ার জুতো কিনে দিয়ে অসিরের হাতে তুলে দেয়। অসির নিতে না চাইলেও হাতে করে ধরে রাখতে বলে। এরপর ইমরান সাহেব অসিরের বাবা-মা’য়ের জন্য নতুন পাঞ্জাবি ও শাড়ি কিনে নিজের হাতেই রেখে বলে, ‘এবার চলো বাবা।  তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমরা বাড়ি যাব।’
এই বলে দুটি রিক্সা যোগে ইমরান সাহেব অসিরদের বাড়ি যায়। ইমরান সাহেবকে দেখে অসির বাবা-মা চমকে উঠেন! তারা খুব খুশি হয়ে শোয়ার ঘরের খাটের উপরে বসতে দেয় এবং চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে শুরু করে। ইমরান সাহেব ও তার স্ত্রী বলে, ‘না না, আমরা কিছুই খাব না। এখনই চলে যাব। কাল আপনি সকালে  ভ্যান গাড়িটি নিয়ে বাজারে থাকবেন। আমি চাউলের বস্তাসহ আরো কিছু বাজার-সওদা করবো- সেগুলি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবেন।’
এই বলে ইমরান সাহেব তার হাতে থাকা জামা-কাপড়ের ব্যাগটি অসিরের হাতে দিয়ে বলেন, ‘এই ব্যাগটা রাখুন। আর এই যে ধরুন, এখানে কিছু  টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে ঈদের খরচাপাতি করে সবাই আনন্দ করে ঈদ করবেন!’ এই বলে তারা বেরিয়ে পড়লেন।
অসির বাবা-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। তাদেরকে অনেকটাই নির্ভার লাগছে। হ্যাঁ, এবার ঘন মেঘের পর্দা ফুঁড়ে সত্যিকারের ঈদ নেমে আসছে অসিরদের বাড়িতে।

×