ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

এই যে বেঁচে আছি

সাইফুজ্জামান

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ২০ মার্চ ২০২৫

এই যে বেঁচে আছি

তিরিশ বছর চার মাসের সম্পর্ক ছিন্ন করে রাত্রির চলে যাওয়া আমার জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না।
না। প্রথম প্রথম মন খারাপ হয়ে নিজের আবর্তে ঘুরপাক খেতাম। তারপর থেকে বুঝতে পারি এটাই স্বাভাবিক, আমাকে বাস্তব মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এইতো আমার নিয়তি। দুই ছেলেমেয়েকে বড় করে তুলতে হবে। নিজেও ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে। তারপর আলো-আঁধার, ঝরাপাতার ক্রন্দন, ঝড় অতিক্রম শেষে দিনযাপনকে উপভোগ করতে শিখি। ছোট বেলা থেকে একেক করে কতজনকে হারিয়েছি। বাবা চলে গেছেন, আত্মীয়স্বজন কত মানুষেরা অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। প্রথম প্রথম কষ্ট হয়েছে। তারপর সহ্য হয়ে গেছে। অভিযোজন করেছি সব বেদনা সব হারানোকে’ নিজের মধ্যে। যে চলে যাবার তাকে ধরে রাখা যায় না।
রাত্রির শরীর খারাপ। শরীরে একটা ছোট অপারেশন হয়েছে। মানসিকভাবে বিপর্যন্ত- আমি জেনেছি তার
কাছের মানুষদের কাছ থেকে। যে সমস্ত দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াতো, যার মানসিক শক্তি ছিল অন্যদের থেকে অনেক উঁচুতে সেও অনেকখানি স্থিতু। কেউ বুঝতে পারে না। তার কথা বলার স্টাইল আগের মতো রয়েছে। খাওয়া দাওয়ার তালিকা থেকে রাত্রি অনেক কিছু বাদ দিয়েছে। তবু অনেকখানি সে নিষ্প্রভ। সে-ই আমাকে প্রথম বাদ দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তার জীবনে ছিলাম অমোঘ সত্য আলোর মতো দীপ্তিময়। সে যখন আমাদের সমস্ত ডিল/চুক্তি ছিন্ন করার কাগজে স্বাক্ষর করলো তখন অনেকখানি হাসি খুশি ছিল। আমি সুখী, অসুখী, সন্তুষ্ট, অসন্তুষ্ট কিছুই বুঝতে দেইনি। কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে দুইজন দুটি রিক্সায় ভিন্ন গন্তব্য আমরা পৌঁছেছিলাম। ছেলেমেয়ের জন্য আমাকে শক্ত থাকতে হয়েছিল। পুরুষের চোখে জল কাউকে দেখাতে নেই আমিতো জানি। আমি একাকী নিজের ঘরে বসে প্লেয়ার বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান
শুনেছিলাম অনেকক্ষণ। কিছুদিন পর অনেকে বলেছিল দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা। ন্যাড়া কি বেল তলায় কি বারবার যায়?
তখন অনেকখানি হাসি খুশি ছিল। আমি সুখী,
অসুখী, সন্তুষ্ট, অনুনুট কিছুই বুঝতে দেয়নি।
কাজ, ব্যস্ততার মধ্যে এর মধ্যে নয় বছর কেটে গেছে। রাত্রির সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। রাত্রি সযত্নে ভুলে গেছে তার ছেলেমেয়েকে। ছেলে-মেয়েরাও একবারও তার কথা বলেনি। মনে হয় বাবাকে নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি ওরা দাঁড় করাতে চায়নি।
অনেকদিন ঘটনাবর্তে আমার জীবন উত্তাল থেকেছে। আজ এসেছি রাত্রির অফিসে। এ অফিস আমার অফিসও বলা যায়। আমি আর রাত্রি একই অফিসে কাজ করেছি বহুদিন। আমার অফিস ছিল নীচতলায় ওর অফিস চতুর্থতলায়। রাত্রি যখন চাকরিতে প্রবেশ করে সেটা ২০১০ সালে। আমিতে ১৯৯৪ সাল থেকে আছি।
আমাদের নীচতলায় নিয়মিত আড্ডা জমে উঠতো কাজ শুরু হওয়ার আগে। শিল্প, সংস্কৃতি, অফিস রাজনীতির গল্প বাদ যেতোনা। একদিন রাত্রি এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দেয়। দিনে দিনে আমি তার রূপ-কাজ জ্ঞানে মুগ্ধ হতে থাকি। একদিন রাত্রি বলে কয়েকদিন ধরে ওর জ্বর। আমি প্যারাসিটামল কিনে আনি এক পাতা। রাত্রি টেবিলে রাখা কাচি দিয়ে একটা ওষুধ কেটে নিয়ে আমাকে বাকি ওষুধ ফেরত দেয়। আমি বলি ‘রেখে দিন- অন্য কখনো কাজে লাগবে। রাত্রি নেয় না। রাত্রি একবার না বললে সেটা চড়ান্ত না। ওকে ‘হ্যাঁ’ বলতে শুনেছি অনেক বার।
রাত্রির জন্মদিনে আমি কয়েকটি প্রাইজবন্ড উপহার দিই। ও বলে’ নিতে পারি একটি’। আমি ফেরত নিতে নারাজ। আমি দ্রুত হারিয়ে যাই। ও বলে একজন আমাকে দশটাকা দিয়েছিল আমি ও টাকা আজো জমা রেখেছি।
রাত্রির অফিসে পার্টিতে মাঝ খানে বসি। সবাই সামনে টেনে নিয়ে যেতে চায়। অনুষ্ঠান শুরুর আগে রাত্রি আসে। অনুষ্ঠান আলোচনা-বক্তৃতা শেষে রাত্রি চলে যায়। আমি বসে আছি। রাত্রি তাকায় না,
আমাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে, এমকি আমার দিকে একবারও না দেখে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে। আমি অনুষ্ঠা চলে যাওয়া দেখি,। রাত্রি আমার কিছু নয়, আমি রাত্রির কেউ নই। বুক ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস রেড়িয়ে শূন্য মিলিয়ে যায়। আমি নিজেকে সামলে নিই।আমি প্রথম সারিতে গিয়ে বসি। একদল শিল্পী নাচ, গানে ভরপুর সেগুন বাগিচার হল রুম। আমি মোবাইল খুলে ভিডিও করি, স্থিরচিত্র তুলি। কোথাও অলক্ষ্যে কোকিল ডেকে ওঠে। শীত সন্ধ্যা ভেদ করে টুপটুপ ঝরে পড়ে শিশির। পাতা ঝরার শব্দ শুনি। কোকিল ডাকে। অন্তর্গত আত্মা বলে আমার নামে কেউ কি ডেকে চলেছে কোথাও। আমাকে ভাবার মতো এ মুলুকে কেউ নেই। ভুল ভালোবাসায় কেটে গেল সারা জীবন। হায় জীবন কত নামবুর, কত না বেদনার। আমরা শুধু আমাদের স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাই। কেউ কাউকে মনে রাখে না। দূর থেকে ভেসে ওঠে
রবি ঠাকুরের সেই
গান ‘যখন পড়বে না
মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।
কি বিষাদ আর স্মৃতিতে মাখা। এক ঘোর মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। রাত্রি কি সব ভুলে বসে আছে? রক্তমাংসের মানুষ স্মৃতি শূন্য হয়ে যায় কীভাবে?
আমি অনেকক্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাটিয়ে ফিরে যাই খাবার টেবিলে। পুরনো দুই একজন এখনো আছে। তাদের সাথে কথা হয়। সিও’র পাশাপাশি বসি। সেই আড্ড সেই সব হারানো দিনের গল্প আমাদের পিছনে নিয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশতো বলেছেন ‘কেউ হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!”

০৯.০৩-২০১০
সময় কত দ্রুত চলে যায়। রাত্রি তার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট এক পুরুষকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। আমাদের কারো সাথে ওর যোগাযোগ নেই। ছেলে-মেয়েরা বড়ো হয়েছে। বড় ছেলের বিয়ে দিতে মেয়ে খুঁজছি। লেখালেখি, আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা সাফাতের মধ্য দিয়ে দিনরাত্রি চলে যায়। রাত্রিকে আমাদের কারো মনে থাকে না। মনে রেখেই বা কি হবে? আমাদের সময় কাটে জীবনের নিয়মে।
প্রতিদিন কত মানুষের সাথে দেখা হয় রাত্রিকে নিয়ে যেসব রেস্তোরাঁ জাদুঘর, লাল বাগ, পুরান ঢাকার দর্শনীয় জায়গা, উয়ারীর হোটেল আল রাজ্জাক, ভোজন বিলাস, স্টার, নীরব, কোলকাতা কাচ্চি, গ্রান্ড কাবাব, ঘুরে ফিরি সূচনা, শিউলি
কিংবা সেলিম, আনন্দদের সাথে। দলবেঁধে সিনেমা, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় হইহই করি শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি, নভোথিয়েটার, সামরিক জাদুঘর, চন্দ্রিমা উদ্যান। একেকদিন একেকভাবে গল্পগুজব, স্মৃতিবিস্মৃতির ভিড়ে চলে যায়।

একাকী ঘরে বসে বসে রেকর্ড প্লেয়ারে বরীন্দ্র সঙ্গীত, হেমন্ত-মান্নাদে, শচিন কর্তা শুনতে শুনতে কখনো চোখ ভিজে যায়। রাত্রি তবু ঢুকে পড়ে স্মৃতির ফাঁক ফোকর দিয়ে। আমাদের প্রেম, আড্ডা- বিয়ের দিন এমনকি ওর চলে যাওয়ার স্মৃতি, আমাকে আকড়ে ধরে যখন মুহূর্তে আমি কাজে ডুবে যাই।
রাত্রি চলে যাওয়ার সময় শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, অলংকার ও নিত্যব্যবহার্য রেখে চলে গেছে। আমাদের যুগল ছবি আমাদের মাস্টার বেড রুমের সাইড টেবিলে আমরা রেখে দিয়েছি। ছেলে-মেয়েরা ওর মাকে দেখুক, যদি স্মৃতি মগ্ন হয় ওরা সেই আনন্দ বেদনা থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না ভেবেছি।
আমাদের বিয়ের দিন, রাত্রির জন্মতারিখ কিংবা ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন- পরীক্ষা পাসের বছর এসব আমার কোনদিন মনে থাকতো না। সবার কাছ থেকে বকা খেয়ে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম।
রাত্রির সাথে যখন ঘর সংসার শুরু হয়নি তখন ওর একটা ছোট অপারেশন হয়। খবর পেয়ে রাত্রিদের পুরান ঢাকার বাড়িতে ছুটে যাই।
রাত্রি নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গিয়ে আমার জন্য টেবিল ভর্তি খাবার আয়োজন করেছে। বলি তুমি অসুস্থ- এতো আয়োজন কেন। এ সব ঝামেলায় কেনো গিয়েছো। আমার চোখে জল আসে। আমি কিছুই খেতে পারি না। চোখ ঘুরিয়ে নিই অন্যদিকে। নিজের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করি। একবার আমাদের এক কলিগের ছেলের বিয়েতে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। যাওয়ার আগে রাত্রিকে বলি, আসবো নাকি, আপনাদের বাসায়।’ বলে দলবেঁধে চলে আসুন। তাহসিন আপার গাড়িতে আমরা রওনা হই। আমি দিক ভোলা মানুষ। যাওয়ার পথে কয়েকবার ফোন করি। ও ড্রাইভার কে যাওয়ার পথ বলে দেয়।
রাত্রিদের বাড়িতে পৌঁছে আমরা সবাই অবাক। পায়েস, নানা জাতের ফল টেবিলে আসে। একটু পরেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। বিশাল আয়োজন করে ও বসে আছে। ওর হাতে বানানো দুধচা অমৃতের মতো লাগে। হায়রে সেই সব দিন।
আমাদের কারো পক্ষেই আর সেসব দিনগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল সাদামাটা। আমি মফস্বলের মানুষ। ওরা আদি ঢাকাবাসী। ওদের অনুষ্ঠানটি ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। আমরা বউভাত পর্যন্ত করতে পারিনি। চাকরি শুরুর এক বছর পর আমাদের বিয়ে হয়। বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। তার টাকায় বিয়ের অনুষ্ঠান সারতে হয়। অনেক কিছু বাদ দিতে হয় তখন আমি সামান্য চাকুরে।
পরের দিন আমরা গাউছিয়া যাই। সামান্য টাকা দিয়ে ইমিটেশনের কানের দুল কিনি সাথে রজনীগন্ধ্যা। বিয়ের আগে গল্প কথাবার্তা হয় আমাদের ম্যাগনোডালাস চাইনিজ রেস্টুরেন্ট কলা বাগানে। রাত্রি তার বোনকে সাথে নিয়ে আসে। আমি আমার খালার সাথে যাই। আমি প্রথমে বলি আমার বেতন চার হাজার দুইশো চব্বিশ ঢাকা সায় ত্রিশ পয়সা- চলতে পারবেন? মাথা নীচু করে থাকে। আমরা শুধু স্যুপ খেয়ে বেড়িয়ে আসি। পরে জেনেছি রাত্রির ছোটবোন রাত্রিকে বলেছে
‘লোকটা কৃপণ।’ তারপর সুখদুঃখের দিনগুলো আমাদের কাটে আনন্দ-বেদনায়।
বিয়ের পর আমরা একটি ডিম দুই ভাগ করে খেয়েছি। রাত্রিদের বাড়ি থেকে আমাদের জন্য খাবার এসেছে। আমাদের বেতন বেড়েছে। রাত্রি চাকরিক্ষেত্রে সম্মানজনক অবস্থায় চলে গেছে। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছি। আমাদের অনেক চবি ড্রয়ারে পড়ে আছে। ছেলে মেয়েরা মাঝে মধ্যে দেখে। আমি কিছুই দেখি না। কেবল একটা ক্রন্দন ফেরি করে বেড়াই। জানি কোনদিন আমার রাত্রি ভোর হবে না। বাস্তবতাতো মেনে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। এই যে দিন যাপন, বেঁচে থাকা এতেই আমি তৃপ্ত। এই জীবন আনন্দ-বেদনার সহোদর।

×