
হাসান আজিজুল হক তাঁর ষাট বছরের দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন বিচিত্র অনেক ছোটগল্প ও সমৃদ্ধ গদ্য। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার, আগুনপাখির আগ পর্যন্ত তাঁর কাছে থেকে আমরা তেমন কোনো উপন্যাস পাইনি। তাঁর আগুনপাখি উপন্যাসটি নানাভাবে পুরস্কৃত, প্রশংসিত ও আলোচিত হওয়ার পরও তিনি অতি সংযমী ছিলেন। আগুনপাখি রচনার বহুদিন পর তিনি লিখছেন আর এক অসাধারণ উপন্যাস সাবিত্রী উপাখ্যান। একজন সাধারণ কিশোরীর ধর্ষিত হওয়া থেকে তার নারী হয়ে ওঠা এবং জীবনসংগ্রামের আখ্যান সাবিত্রী উপাখ্যান।
সাবিত্রী উপাখ্যান বইটি বাস্তব ঘটনার উপরে লিখিত। সাবিত্রি ব্যানার্জি নামক একজন ব্রাহ্মণ মহিলার শিশুকাল থেকে শুরু করে কিশোরী বয়সে ক্রমাগত ৮ মাস অনেক ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ ও তাকে খুঁজে পাবার পর মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে ক্রমান্বয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। বইটিতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে কিছু পুরুষ মানুষের পাশবিক চেহারা, নারীদেহ বাঘের থাবার মতো ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার কাহিনী। কিন্তু এর মাঝেও সাবিত্রির মরেও বেঁচে থাকার ঘটনা ফুটে উঠেছে ব্রিটিশ ভারতের পুলিশের দায়সারা ভাব। গল্পটি শুরু হয় বৃদ্ধা সাবিত্রির জোছনা না অমাবস্যা এই ঘোর নিয়ে। সে সবসময়ই জানতে চাইত চাঁদ আছে কি নেই। চাঁদ না থাকলে তিনি খুশি থাকতেন। এর কারণ হিসেবে আমরা দেখি তাকে প্রথমবার অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়েছিল জোছনা রাতে পূর্ণ চাঁদের আলোয় খোলা মাঠের নিচে। সাবিত্রিরা ছিল দুই ভাই এক বোন। সাবিত্রির বড় দাদা মারা যান তার জন্মেরও আগে। সাবিত্রির মা মারা যায় তার জন্মদানের সময়ই। এরপর সে মানুষ হতে থাকে তার বাড়ির কাজের লোকের হাতে। কিন্তু তিনিও মারা যান কলেরায়। এরপর সাবিত্রির দায়িত্ব ঘাড়ে নেন তার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় নিশিবালা যাকে সাবিত্রি সম্বোধন করত দাড়িদিদি বলে। দাড়িদিদি মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই মাতৃস্নেহে মানুষ করতে থাকে সাবিত্রিকে। সাবিত্রির যখন ৭ বছর বয়স তখন তার বিয়ে হয় দুকড়ি চট্টোপধ্যায় নামক একজন লোকের সঙ্গে। সাবিত্রির বাবা এর কিছুদিন পর মারা যান। সাবিত্রির দাদা গুড়ুদাস ব্যানার্জির কাপড়ের ব্যবসা। সে সেগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তার সঙ্গে তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। সাবিত্রির স্বামী কলকাতা যাবে বলে সাবিত্রির কাছে কিছু টাকা জোগাড় করে দিতে বললে সে তার বিয়ের সময় বাবার দেওয়া একটি অনন্ত নিশিবালার মাধ্যমে দুর্গাদাস ওরফে তেলার কাছে বন্ধক দিয়ে আট টাকা দুকড়িকে দেয়। দুকড়ি কলকাতা গিয়ে একটি মুদি দোকানে চাকরিতে ঢোকে। কিছুদিন পর সে দশ টাকা পাঠিয়ে দেয় অনন্তটি ছাড়িয়ে নেবার জন্য। কিন্তু দুর্গাদাস গড়িমসি করতে থাকে। তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সে বিভিন্ন টালবাহানা করতে থাকে। এরপর জানায় সে সেটি আরেকজনার কাছে বন্ধক দিয়েছে। পরে বলে অনন্তর মালিক এসে অনন্তটি যেন নিয়ে যায়। সাবিত্রি এতে অস্বীকৃতি জানায়। ইতোপূর্বে সাবিত্রির সঙ্গে তার স্বামীর সহবাস হয় নাই। কিন্তু ইতোমধ্যে সে বয়সন্ধির পর নারীতে পরিণত হয়। এরপর যেদিন সাবিত্রির স্বামীর কলকাতা থেকে আসার কথা সেদিন ডোম বউ সরোজিনি তাকে বলে, তেলা তাদের বাসায় বসে আছে। সে গেলে অনন্তটি ফেরত দেবে। প্রথমে রাজি না হলেও সাবিত্রি পরে রাজি হয়। নলিনের হাতে টাকা দিয়ে অনন্তটি আনতে গেলে আমবাগানের অন্ধকারে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেলা, বটা ও সবুর। এরপর শুরু হয় ক্রমান্বয়ে ধর্ষণ। কিছুদিন পর সবুর সাবিত্রিকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায় এবং সে এবং তার পরিচিত পুরুষরা তাকে ধর্ষণের পর ধর্ষণ করতে থাকে। এভাবে বিভিন্ন স্থানে আটমাস তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করে একদিন রাতে তাকে বর্ধমানে ছেড়ে দিয়ে সবুর পালিয়ে যায়।
সাবিত্রী ছিল জীবন্ত লাশ। যারা তাকে নিয়ে একদিন পালিয়েছিল, সাবিত্রী তাদের কাছে অনেক বড় বোঝা হয়ে গিয়েছে। ওরা নুয়ে পরেছিল। কোথায় ফেলবে এই বর্জ্য। তখন আর্বজনার মতো ফেলে দিয়ে গেছে বর্ধমানে। সাবিত্রী ফেরার খবরে পাড়ার টকটকে সিঁদুর পরা বৌ-ঝিরা মুখ বেঁকিয়ে বলেছে -
‘সাবি, আপনা-আপনি ফিরে এসেছে কুল খুইয়ে।’
একটি কন্যা শিশুর নারী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সংসারে পদার্পণের কথা ছিল। কিন্তু তার রূপ তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। জীবনের হিসাবের খাতায় পূর্ণ হয়ে থাকে শূন্যতা আর ব্যর্থতা দিয়ে। সাবিত্রীকে প্রতিবাদী কিংবা তেজী দেখা যায়নি। সে নীরবে সব অত্যাচার সহ্য করে গেছে কেবল। এই ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে এটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে রূপ নেয়। বিভিন্ন গ্রামে একের পর এক লাশ পড়তে থাকে। কোনোদিন হিন্দু গ্রামে, কোনোদিন মুসলিম গ্রামে লাশ পড়তে থাকে।