
তেয়াত্তরটি কবিতার সংহিতা এ ‘মাটির মন্দিরা’। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য ধারায় চর্চিত কাব্যমালা নিয়ে কবি শামীম আহমদ এ বছরের বইমেলায় এনেছেন এই কাব্যসংগ্রহ। ইতোমধ্যে তার দশটি কবিতার বই বাংলা সাহিত্যে সংযোজিত হয়েছে।
কবি শামীম আহমদ আমাদের মাঝে সেই কবি যিনি একই সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, মানুষের যাপিত জীবন সুন্দরভাবে সজ্জিত করে তার কবিতা আমাদের উপহার দিতে পারেন। এ কারণে তার কবিতায় দেখা যায় অজস্র জীবনধারার অনুপ্রবেশ। শুধু অনুপ্রবেশ করেই ক্ষান্ত হয় না, মানব জীবনের বাস্তব চিত্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যায়।
‘পিরিতে বান্ধা এ সংসার/ জল পবন আর আগুন মাটি, শূন্যে একাকার।/ মাটির মন্দিরা বাজে বাতাসের দোতারা,/ জলের মধ্যে ঢেউ তুলিয়া নাচে প্রাণভ্রমরা।/ দেখে ছবি পাগল কবি, সুরে ধরে গান,/ গান শুনিয়া নৃত্য করে জমিন আর আসমান।’ (মাটির মন্দিরা : গীতিকাব্য-পৃ-৭৮)। মন্দিরা সচরাচর মাটির হয় না। কিন্তু এখানে মাটির মন্দিরা বলে কবি মানবেরই যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক চলার পথের একটি ধারাবাহিকতা সন্ধান করেন যেখানে আমাদের অবিনশ^র আত্মাগুলোর দৈনন্দিন হাসি-তামাসা, মনোজাগতিক ক্রিয়া-কর্ম আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে যে উদ্বেলিত করে তারই চিত্র প্রস্ফুটিত করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ কবি জীবনের সঠিক তত্ত্বটি তার মতো করে তুলে ধরেন।
শামীম আহমদের কবিতায় দৃশ্যকল্প, উৎপ্রেক্ষা, আমাদের নিয়ত জীবন যুদ্ধের চিত্র অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে গ্রন্থিত হয়। আর তার কবিতার চরণে চরণে এ চিত্র রজ্জুবদ্ধ হয়। ‘মানুষের মতো পশুদেরও কি হৃদয় আছে?/ যেখানে মমতায় লালন করে শাশ^ত প্রেম।/ জন্মন্তর কিংবা পূর্ণজন্ম কি বোঝে ওরা/ যে পশু বলি হয় প্রতিদিন কসাইয়ের ঘরে/ কুরবানি অথবা মন্দিরে ইশ^র আরাধনায়?/ হয়তো স্মৃতিতে তার অনেক কান্না জমে আছে/ গলায় খঞ্জরের দাগ আবারও মুছে দেয়/ এজন্মের রক্তের স্রোত!’ (পশু ও প্রেম : পৃ-১৬)।
‘দৃষ্টির গিরিসীমা ভেঙে গেলে দেখি/ পর্বতের উদর থেকে/ একটি উপত্যকা বেরিয়ে এলো/ আমি হাঁটছি এই বিশাল উপত্যকা জুড়ে।/ পাহাড়কে চালুনি দিয়ে নাড়িয়ে/ সময় যে পথ বের করে এনেছে/ এই পথ শুধু/ সময়ের মিথ্যাচার দিয়ে মোড়ানো/ রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেগে আছে/ ঈশ^র আর মানুষের যোজন দূরের স্মৃতি!” (চলমান বর্তমান : পৃৃ-১৭)। এখানে কবির চিত্রকল্প ও রূপকল্প এক ভিন্নমাত্রায় ভিন্ন পথে চলে, ‘পাহাড়কে চালুনি দিয়ে নাড়িয়ে/ সময় যে পথ বের করে এনেছে/ এই পথ শুধু/ সময়ের মিথ্যাচার দিয়ে মোড়ানো/’- এখানে আমাদের বর্তমান সভ্যতার ও সময়ের পুঙ্খানুপঙ্খ ভঙুরতাকে ব্যবচ্ছেদ করে কবি তার দৃষ্টিকোণে আনেন ভিন্ন এক দৃশ্যকল্প। অথচ তা কবির চোখে আসে যোজন দূরের স্মৃতি।
‘পঞ্চব্যঞ্জন আর ভাল্লাগেনা/ স্নায়ুতন্ত্রের কোরাস শুনে শুনে গতি সঞ্চালন করি/ তবুও এ নগর কবরের মতো নিঃসঙ্গ লাগে/ এখানে নিঃস্ব সময় টলোমলো চোখ/ বোবা স্রোত উত্তপ্ত হ্রেষা।/ মনে হয় যেন গুমোট আঁধারে স্থির হয়ে আছে সব!/ অসীম ক্ষুধায়-/ শরীরের চোরাপথে নাসহ্য যন্ত্রনা অঙ্কুরিত হয়/ যখন কালের উনুনে জ¦লে চিন্তার চিতা!/ কথারা চিবিয়ে খাচ্ছে কথার মাংসল গ্রন্থি/ কেবল হাড্ডির গুহায় বিদ্রোহ চিকচিক করে/ স্বচ্ছ জলে সূর্য্যরে মতো।/ এই শে^ত দ্বীপে শীত চুম্বনে জমে যাওয়া জিহ্বা/ ভেঙে চুর হয়ে গেছে।’ (টেমসের বোবাস্রোত : পৃ-৫৯)।
শামীম আহমদের কবিতা মন দিয়ে পড়তে হয়, কবিতার চরণস্থিত চিত্রকল্প ও দৃশ্যকল্পগুলো ভাবতে হয়। একবার এ গভীর পাঠ ও নিরীক্ষণ যখন পূর্ণতা পায়, তখন দেখা যায় এক বিশাল সুন্দর নন্দনতত্ত্ব ও ব্রহ্মাণ্ডের শৈল্পিক জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে এ কাব্যে কবি তার আগের কাব্যভাবনার সঞ্চরণ ও সন্তরণ অব্যাহত রেখেছেন, নতুন স্রোতস্বিনীতে যেতে চাননি।