ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১

‘ঘষা কাঁচে’ সাংবাদিকতার অলিগলি নাকি আত্মজিজ্ঞাসা?

সৈকত কবির শায়ক

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ১০ মার্চ ২০২৫

‘ঘষা কাঁচে’ সাংবাদিকতার অলিগলি নাকি আত্মজিজ্ঞাসা?

প্রচ্ছদে কালোর আবহ, শিরোনামে একটি প্রতীকী ভাবনায় ‘ঘষা কাঁচে’

উল্টাতে উল্টাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটি নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়। সাবলীল গদ্যে লেখা বইটি সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেনএটি ‘ঝকঝকে সকালের ক্লান্তিহীন গতিময়তার প্রতিশ্রুতি, কিন্তু একইসঙ্গে ‘বিষাদের আবছায়া-ও রয়েছে এর পরতে পরতে। এই দ্বৈত অনুভূতিই পাঠককে আকৃষ্ট করে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে কতশত কিংবদন্তি রয়েছেন, যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। মূলধারার আলোচনায় তাঁদের সাফল্য কিংবা সংগ্রামের কথা উঠে আসে না, অথচ তাঁদের অবদান কম নয়। ঠিক এমনই কিছু বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াবিদের গল্প তুলে এনেছেন তরুণ লেখক বইটির শুরুতে।

ইভান ইকরামের সাংবাদিকতা জীবনের ছাপ পড়েছে বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আড়ালে থাকা অনেক গল্প তিনি অনুসন্ধানী নয়, বরং ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ হিসেবেই তুলে ধরেছেন। ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে গিয়ে তিনি ভলিবল, দাবা, অ্যাথলেটিকস এবং প্যারা-স্পোর্টসের বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াবিদদের কথা বলেছেন।

ক্রীড়াবিদদের জীবন শুধু মাঠের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের লড়াই শুরু হয় মাঠের বাইরেও। সেই লড়াই কখনো প্রতিষ্ঠার, কখনো স্বীকৃতির, কখনোবা নিছক জীবনধারণের। পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে এক ভিন্ন জগত, যেখানে ওয়াহিদুল গণির স্পিন, রকিবুল হাসানের সাহস কিংবা নিয়াজ মোরশেদের দাবার চাল এক নতুন ব্যাখ্যা পায়। ফুটবল কোচ ওয়াজেদ গাজী, ভলিবল তারকা ইয়াদ আলি কিংবা কমনওয়েলথ পদকজয়ী আব্দুস সাত্তার নিনির গল্পগুলো যেন শুধুই তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্যের নয়, বরং সময়ের কাছে হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়ের পুনরুদ্ধার।

লেখকের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে উঠে আসে ময়মনসিংহের এক অজপাড়া গাঁয়ের গল্প, যেখানে ফুটবল খেলে বদলে গেছে পুরো একটি গ্রামের চেহারা। কলসিন্দুরের সেই মেয়েরা, যারা সমাজের গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গিকে ভেঙে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। কে জানত, ছোট্ট একটি বল বদলে দিতে পারে একদল কিশোরীর জীবন, বদলে দিতে পারে একটি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ! অথচ এমন ঘটনা কতবার ঘটে, কজনই বা সে কথা জানে!

সাংবাদিকতার জীবনও যে কতখানি ঘটনাবহুল, তা লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। কখনো মাঠের সীমানায় দাঁড়িয়ে দেখা খেলা, কখনো খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, কখনোবা দূর-দুরান্তে সফরএসবের বর্ণনায় জীবনধর্মী এক আখ্যানের স্বাদ পাওয়া যায়। গদ্যের ভেতর যেন রঙিন কাচের মতো ভেসে ওঠে দৃশ্যগুলো। কোথাও সরাসরি বলে দেওয়া হয়নি কিছু, বরং শব্দের গাঁথুনিতে একেকটি অনুভূতির দৃশ্য তৈরি হয়েছে। মাঠের উন্মাদনা, গ্যালারির শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত, ক্রীড়াবিদের ক্লান্ত-অবসন্ন মুখ কিংবা বিজয়ের হাসিসবকিছুই অনুভব করা যায় লেখকের ভাষার গভীরতায়।

বাক্যের কারুকাজে সহজ-সাবলীল অথচ গভীর এক প্রকাশভঙ্গি। অল্প কথায় অনেক কিছু বলার মুন্সিয়ানা লেখকের কলমে স্পষ্ট। কোথাও কোনো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা নেই, কোথাও আবার ছোট্ট একটি বাক্যে গভীর জীবনবোধ। ক্রীড়ার প্রতি ভালোবাসা, খেলোয়াড়দের প্রতি মমতা আর জীবনের প্রতি তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে মিলে এক মায়াবী গদ্য সৃষ্টি করেছে।

তবে, বইটি শুধুই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সীমাবদ্ধ নয়। বরং লেখকের ভ্রমণ ও জীবন উপলব্ধি উঠে এসেছে সমান গুরুত্ব নিয়ে। খেলা কভার করতে গিয়ে বা নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তিনি যেসব দেশ দেখেছেন, সেসব অভিজ্ঞতার জীবন্ত বর্ণনা ও নিজস্ব জীবনদর্শনের সংমিশ্রণ বইয়ের এই অংশটিকে স্বাদু করেছে। তাঁর গদ্যে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন শহরের চিত্র, নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং সেসবের সাথে লেখকের আত্মিক সংযোগ। একদিকে যেমন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের অজানা অধ্যায় জানতে পারেন, অন্যদিকে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে এক নতুন বাস্তবতার উপলব্ধি।

বইটির অন্যতম শক্তির জায়গা এর ভাষার ব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত অনেক বইয়ে সাহিত্যের গভীরতা অনুপস্থিত থাকলেও, ইভান ইকরামের লেখায় বাংলার সৌন্দর্য ও শৈল্পিক প্রকাশ স্পষ্ট। শায়েরি ও সংগীতের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অনুরাগ বইয়ের বিভিন্ন অংশে প্রকাশ পেয়েছে, যা পাঠকের জন্য এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা তৈরি করে। তাঁর বর্ণনায় গল্প বলা নয়, বরং গল্প দেখানোর প্রবণতা লক্ষণীয়। ‘Show, Don’t Tell’ পদ্ধতির দক্ষ প্রয়োগে তিনি ভাষার গাঁথুনিতে দৃশ্য তৈরি করেছেন।  আত্মজিজ্ঞাসার কয়েকটি ছত্রে লেখক শুধু অনুভূতি বর্ণনা করেননি, বরং পাঠককে দৃশ্যকল্প অনুভব করিয়েছেন। তাঁর লেখার গভীরতা এখানেই, কারণ তিনি সহজ অথচ তীক্ষ্ণ ভাষায় অনুভূতির মূর্ছনা সৃষ্টি করেছেন। 

তবে কিছু চরিত্রের পরিসর যেন আরও বিস্তৃত হতে পারত। অনেকের জীবন উঠে এসেছে মাত্র কয়েক পৃষ্ঠায়, যেখানে পাঠকের কৌতূহল আরও গভীরভাবে জানার তাগিদ অনুভব করে। তথ্যের ঘাটতি কখনো কখনো অপূর্ণতার অনুভূতি তৈরি করলেও, গতানুগতিক স্মৃতিচারণের বাইরে এসে এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করাই প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের বহু অংশ এখনও অনাবিষ্কৃত। ‘ঘষা কাঁচে সে শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ করার প্রয়াস নিয়েছে। ইভান ইকরাম একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে যে দায়বদ্ধতা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তাঁর অন্তঃর্মুখী দৃষ্টি, ও ঝরঝরে গদ্য বইটিকে করেছে স্বতন্ত্র।

লেখকের প্রথম প্রয়াস হিসেবে বইটির সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে যদি তাকাই, ঘষা কাঁচে শুধু ক্রীড়াঙ্গনের গল্প নয়, ভিন্ন সময়ের প্রতিচিত্র হিসেবেই উঠে আসবে। যারা আলোচনার বাইরে থেকে যান, সম্ভবত লেখক নিজেও, তাঁদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমন বই শুধু ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য নয়, বরং যে কেউ পড়লে বুঝতে পারবেন, কীভাবে খেলার বাইরেও লড়াই থাকে, থাকে গল্প, থাকে জীবনবোধ। ভাষার গাঁথুনি, বর্ণনার সৌন্দর্য আর গভীর অন্তর্দৃষ্টির কারণে এই লেখকের আরও লেখা পড়ার জন্য পাঠকের মনে আগ্রহ তৈরি হবেই। ‘ঘষা কাঁচে নিছক স্মৃতিকথা নয়, এটি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও লেখকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের এক গভীর অনুরণন।

আশিক

×