
ছবি:সংগৃহীত
এক দেশে ছিল একজন বুদ্ধিমান মানুষ। তার মাথা খুব ভালো কাজ করলেও তার কাছে কোনো ধনসম্পদ ছিল না। তার মূল কাজ ছিল হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। একদিন, হেঁটে হেঁটে সে একটি মরুভূমিতে এসে পৌঁছল। সেখানে তার দেখা হল একজন গেঁয়ো পথিকের সঙ্গে, যিনি একটি উটে চড়ে চলছিলেন। উটের পিঠে দুদিকে দুটি বস্তা ঝুলানো ছিল।
বুদ্ধিমান লোকটি পথিককে দেখে খুব খুশি হয়ে তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, "স্বাগতম! তুমি অনেক দূর থেকে এসেছো, দেখে খুব ভালো লাগছে। পায়ে হাঁটা আর ক্লান্তির কথা বাদ দিলাম, একা একা চলতে গিয়ে সত্যিই বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন তোমার সাথে কিছু সময় কাটাতে পারলে ভালো লাগবে।"
পথিক খুশি হয়ে বলল, "হ্যাঁ, আমি একা চলতে চলতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত গান গাওয়া শুরু করলাম। তবে, পায়ে হাঁটা আর উটে চড়ার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আসলে পায়ে হাঁটা ভালো। তাছাড়া, যদি তোমার কাছে উট, ঘোড়া বা গাধা না থাকে, তাহলে চোরে নিতে আসবে না, ঘাস আর লতাপাতা খোঁজার চিন্তা থাকবে না। কবি ঠিকই বলেছেন -
চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, যার নেই গাধা
ঘাস পাতা খড়ের তরে মন নেই বাধা।
বুদ্ধিমান লোকটি হাসি থামিয়ে বলল, "না ভাই, তুমি কী বলছো! যদি কারো গাধা না থাকে, তাহলে তার বোঝা তার নিজের মাথায় চাপবে। দূরপাল্লার পথ চললে পায়ের কষ্ট হবেই। তবে, আমি হেঁটে চলতে একদম খারাপ লাগে না।"
এভাবে নানা বিষয়ে কথা বলে তারা পথ চলতে লাগল। কিছু সময় পরে, বুদ্ধিমান লোকটি কৌশলে জানতে চাইল, "ভাই, এই উটের বোঝা দুটি বেশ ভারী মনে হচ্ছে! বস্তাগুলোতে কি বোঝাই করেছো?"
পথিক উত্তর দিল, "একটিতে গম রেখেছি, আর অন্যটিতে বালি আর মাটির ঢেলা।"
বুদ্ধিমান লোকটি অবাক হয়ে বলল, "তবে কেন? তোমার বাড়িতে কি বালি আর মাটি নেই?"
পথিক বলল, "না, আসলে গমের বস্তা বড় ছিল না, তাই তা উটের পিঠে সঠিকভাবে ঝুলানো যাচ্ছিল না। তাই বুদ্ধি করে আরেকটা বস্তা ভর্তি করে দিলাম বালি আর মাটি দিয়ে, যাতে উটের পিঠে দুটি বস্তা ঝুলে থাকে।"
বুদ্ধিমান লোকটি হাসতে হাসতে বলল, "হা! হা! হা! তোমার বুদ্ধি দেখি মজার! এর চেয়ে ভালো হতো যদি গম দুটো বস্তায় সমানভাবে ভাগ করে নিতেই! তাহলে উটের কষ্ট কমত আর বস্তাগুলোও সহজে উঠানো-নামানো যেত।"
পথিক বুদ্ধিমান লোকটির কথায় মুগ্ধ হয়ে বলল, "ওয়াও, তোমার বুদ্ধি তো সত্যিই অসাধারণ! আমার মাথায় এমন কিছু আসেনি। তোমার মতো বুদ্ধিমান মানুষ না হলে, আমি তো ভুল ভাবেই চলতাম। তুমি আসলেই একজন মহাপুরুষ, জ্ঞানী মানুষ।"
বুদ্ধিমান লোকটি সঙ্গীকে শান্তভাবে বলল, "না, না, এসব কিছুই না। তবে, ভাই, এটা তো খুবই সহজ হিসাব।"
পথিক সজোরে বলল, "না ভাই, আমি তো একেবারে বুঝতে পারছি না। তুমি এত বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয়ই অনেক ধন-সম্পদের মালিক। আর এখন সখের বশে হেঁটে হেঁটে পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছো।"
বুদ্ধিমান লোকটি বলল, "না ভাই, তুমি ভুল বুঝছো। সত্যি বলতে, আমার কাছে এক টাকাও নেই। এখন তোমার সাথে চলছি, কিন্তু জানি না আগামীকাল আমার ভাগ্যে কী আছে, কী খাব, কোথায় যাব—কিছুই জানি না।"
পথিক অবাক হয়ে বলল, "তাহলে তুমি একেবারে নিঃস্ব, ফকির! অথচ আমি একেবারে বোকা হলেও আমার বাড়িতে ১০টি উট, ১০০টি ভেড়া, ৫০টি গরু আছে। জমি, বাড়ি, চাকর-বাকর সবই আছে। আর তুমি এত জ্ঞান-গুণ, বুদ্ধি মাথায় রেখেও নিঃস্ব। তাহলে এসব জ্ঞান-বুদ্ধির কী মূল্য?"
বুদ্ধিমান লোকটি হেসে বলল, "তুমি যা বলছো, তা সত্যি। তবে ভাই, তোমার যে সব ধন-সম্পদ আছে, সেগুলো তুমি টাকা দিয়ে কিনেছো, আর এতে অহংকার করার কিছু নেই। তবে, তুমি যে একটা গাধা তা আমি এখন ভালোই বুঝতে পারছি।"
এ কথা বলেই বুদ্ধিমান লোকটি অন্য পথে চলে গেল। কিছুদূর গিয়ে পথিক ডাকাতদের খপ্পরে পড়ল। ডাকাতদের একজন পথিকের কাছে জানতে চাইল, "তুমি এই বস্তায় কি নিয়ে যাচ্ছ?"
পথিক ইতস্তত করতে থাকলে, এক ডাকাত চাকু বের করে বস্তাটি কাটল। সেখানে ছিল বালি আর মাটির ঢেলা। ডাকাতরা ভেবেছিল, "তুমি আসলেই একটা গাধা। মরুভূমির মধ্যে কেউ কি বালি আর মাটির ঢেলা উটের পিঠে নিয়ে যায়?"
ডাকাতরা চলে যাওয়ার পর, পথিক বুঝতে পারল তার ভুল। বাকি বস্তাটি ছিল গমের, তাই সে খুশিতে হেসে উঠল, "হা হা! আজ তো ভাগ্য সহায় ছিল। বোকামি করে বালি আর ঢেলা নিয়ে না যেয়ে, আমার কষ্টের উপার্জন নাহলে ডাকাতদের হাতে চলে যেত।"
এর পর থেকে পথিক বালি আর গমের বস্তা দুটিতে মিশিয়ে, উটের পিঠে ঠিকভাবে বহন করতে থাকল। তার বোকামি দেখা সত্ত্বেও সে বলত, "আমি যা জানি, তা তুমি জানো না।"
সূত্র: পার্সটুডে
মুহাম্মদ ওমর ফারুক