ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১

অথৈ ও তার বিড়াল

কোমল দাস

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ৭ মার্চ ২০২৫

অথৈ ও তার বিড়াল

অথৈ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার এক কোণে ও একটি বিড়াল দেখতে পেলো। বিড়ালটি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। একটুও নড়াচড়া করতে পারছে না। শুধু ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। বিড়ালটির কষ্ট দেখে অথৈ খুব কষ্ট পেল। ও বিড়ালটি কোলে নিয়ে বাসায় আসলে ওর মা গম্ভীর গলায় বলল, বিড়ালটিকে বাসায় রেখো না। ওকে যেখান থেকে এনেছো, সেখানে রেখো এসো। মা’র কথায় অথৈ অবাক হয়ে মাকে বলল, এটা তুমি কী বলছো মা? তুমিই তো সবসময় বলো সবার উপকার করতে। তাহলে আজ এটা বলছো কেন? মা আর কোনো কথা না বলে চুপ করে অন্য ঘরে চলে গেল।

অথৈয়ের হাতের ওপর বিড়ালটি থরথর করে কাঁপছিল। তাই দ্রুত ও একটি তোয়ালে নিয়ে বিড়ালটির গায়ে দিয়ে আরেকটি তোয়ালে গরম করে কিছুক্ষণ গরম সেঁক দিতেই বিড়ালটি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। তারপর বিড়ালটি কোলে নিয়ে আদর করছে, এমন সময় মা পাশের ঘর থেকে ওর সামনে এসে দাঁড়ালে ও খুব ভয় পেয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, মা এখনই বিড়ালটিকে বাইরে ফেলে দেবে। এটা ভেবে যখন ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল, ঠিক তখনই মা বললেন, বিড়ালটিকে আমার কাছে দাও। মায়ের মুখে এ কথা শোনা মাত্রই, ‘ফেলে দিয়ো না মা’ বলে অথৈয়ের সে কী কান্না! মা বললেন, ফেলে দেওয়ার জন্য চাইনি, দাও, ফেলব না। এটা শুনে অথৈয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে আর হাসছে। এ যেন অন্যরকম এক অথৈ।
বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে মা অথৈয়ের কাছে এসে বললেন, জানো কেন আমি বিড়ালটিকে ফেলে দিতে বলেছিলাম? শোনো বলছি, তখন আমি ঠিক তোমার সমান, আমিও তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। মামাবাড়ি থেকে শখ করে একটি বিড়াল এনেছিলাম পুষবার জন্য। আমার বাবা-মা তখন চাকরি করতেন, তাই সারাদিন আমাকে একা থাকতে হতো। এ কারণে দিনের বেশিরভাগ সময়ই আমি বিড়ালটির সাথে খেলা করতাম। কিছুদিন পর বিড়ালটির চারটি বাচ্চা হলো। আমার খেলার সাথী আরও বেড়ে গেল। তখন খুব মজায় আমার দিন কাটতে লাগল। হঠাৎ একদিন আমার মামার বিয়ে ঠিক হলো। বিয়েতে আমরা সবাই গ্রামে যাব। মামার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সবার মনেই ভীষণ আনন্দ কিন্তু আমার মনে তখন মোটেও আনন্দ ছিল না।
আমি শুধু ভাবছিলাম, আমরা কেউ বাসায় না থাকলে এই ছোট্ট বাচ্চাগুলোসহ বিড়ালটি কী করে থাকবে? কে ওদের দেখাশোনা করবে? কে খেতে দেবে? একদিন আমার মাকে আমি বলেছিলাম, মা বিড়ালগুলোকে আমরা মামাবাড়ি নিয়ে যাব। কী বলো? মা বললেন, এত ছোট বাচ্চা না হলে ওদেরকে বিয়ে বাড়িতে নিয়েই যেতাম। বাচ্চাগুলো এত দূরের জার্নি সহ্য করতে পারবে না। এরপর মা বাসার মালিক ও পাশের কয়েক বাসার লোকের সাথে কথা বলেছিলেন বিড়ালগুলো এ কয়েকদিন রাখার জন্য। আমিও আমার কয়েকজন বন্ধুকে বলেছিলাম কিন্তু তারা কেউই রাজি হননি।
মামার বিয়েতে কমপক্ষে সাতদিন থাকবো, তাই ওদের ঘরে রাখবো না বাইরে রাখবো, কোথায় রাখলে ওরা নিরাপদ থাকবে এটা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে আটকে রাখলে ওরা কী খাবে? প্রতিদিনই বড়ো বিড়ালটি বাইরে গিয়ে কিছু না কিছু খেয়ে আসে। তাই আমরা সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের বাসার সামনে একটি খোলা বাক্সে ওদের রেখে সেটাতে বেশকিছু খাবার দিয়ে আমাদের সামনের বাসার আন্টিকে খেয়াল রাখতে বলে বিয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
সাতদিন পর ফিরে এসে বিড়ালগুলোকে না পেয়ে খুব কেঁদেছিলাম। পাশের বাসার আন্টিকে বিড়ালগুলোর কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি থমকে গেলেন। কিছু না বলে অনেক সময় চুপ থাকার পর বললেন, তোমরা যেদিন গিয়েছো তারপরদিন থেকেই ওদেরকে আর দেখছি না। আমার ধারণা কুকুরে বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলেছে আর সেই দুঃখ এবং ভয়ে মা বিড়ালটাও পালিয়ে গিয়েছে। আন্টির মুখে কথাগুলো শুনে অনেক কাঁদলাম সেদিন। সেই ঘটনা অনেকদিন আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। তখন থেকে আমি আর বিড়াল পুষি না। সেই থেকেই বিড়াল দেখলে আমার প্রচণ্ড ভয় হয়। যদি আবার এমন কষ্ট পাই! সেজন্যই তোমাকে বলেছিলাম বিড়ালটিকে ফেলে দিয়ে এসো। সে যা-ই হোক, মা আজ তুমি ঠিকই করেছো। আজ থেকে আবার আমরা বিড়াল পুষবো। এতে সৃষ্টিকর্তাও খুব খুশি হন। সবারই উচিত এসব প্রাণীদের যত্ন করা।

×