
‘বই’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি জাগে। কারো কাছে বই জ্ঞানের ভাণ্ডার, কারো কাছে নিছক বিনোদনের মাধ্যম। তবে বই যে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বই আমাদের বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। মনীষীগণ বইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক মূল্যবান কথা বলে গেছেন। এই যেমন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও বিখ্যাত বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম বলেছেন, ‘একটি ভালো বই একশোটি বন্ধুর সমান।’
কথাটি শোনতে কেমন কেমন লাগলেও এর যথার্থতা পরীক্ষিত। কেননা বই আমাদের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার এক যুগপৎ ভাণ্ডার। যুগ যুগ ধরেই বই মানুষের পথপ্রদর্শক। বইয়ের পাতায় লুকিয়ে থাকে নানা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, যা আমাদের মনকে আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে, নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটায়। বই আমাদের শেখায়, জানতে সাহায্য করে, কল্পনা ও অনুভূতির জগতে ডুব দিতে উৎসাহিত করে। তাই বই আমাদের জীবনে শ্রেষ্ঠ বন্ধু হতে পারে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজনের সাক্ষাৎকার পড়ে জানতে পারলাম, তারা কারাগারে বই পড়ে কারাজীবনকেও দারুণ উপভোগ করেছেন।
এখানে বন্ধু শব্দটিকে কী ওয়ার্ড হিসাবে ধরে বলতে পারি, যেহেতু মানুষ সামাজিক এবং দলবদ্ধ প্রাণী তাই তারা একা বাস করতে পারে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, যে একা বাস করে সে হয় পাগল না হয় দেবতা। আসল কথা হলো, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই বন্ধু বৎসল। বন্ধু ছাড়া মানুষের পক্ষে বাঁচা অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু সেই প্রাণের বন্ধুও ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা অন্য কোনো কারণে আপনার সাথে গাদ্দারি করতে পারে, আপনার ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি আপনার প্রাণনাশের কারণ হতে পারে। কিন্তু একটি ভালো বই কখনো আপনার বন্ধুত্বের অমর্যাদা করবে না। আপনার সাথে বেইমানি করবে না। এজন্যই কিংবদন্তি ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা- যদি তেমন বই হয়।’ কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের হাতে বই নেই। বুকে বই নেই। তাদের হৃদয়ে বইয়ের জন্য এতটুকুন স্থান নেই। বইয়ের স্থানটি দখল করে নিয়েছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির এখন পর্যন্ত সেরা আবিষ্কার মোবাইল। আমাদের এই প্রজন্ম হাতে মোবাইল নিয়েই যেমন ঘুমাতে যায়; তেমনি ঘুম ভাঙার পরেই সর্বপ্রথম নোটিফিকেশন চেক করে। কানের মধ্যে হেড ফোন লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইনে গেম খেলে। সারারাত জেগে থাকে। সারাদিন ঘুমায়। ফলশ্রুতিতে তাদের মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার অরুচি হচ্ছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে চোখের সমস্যা হচ্ছে, কানের সমস্যা হচ্ছে। স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে। এই যখন অবস্থা তখন আমি এই প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগে আছি বৈকি! আমি মনে করি, প্রত্যেক মা-বাবাই তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার মতোই চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন।
তবে শিক্ষক, অভিভাবক এবং শুভাকাক্সক্ষীদের এই উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা কোনো সমাধান নয়। এর জন্য প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সময় এসেছে অভিভাবক পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত সকলের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার। আমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নই। আমি কেবল চাই এর যথার্থ ব্যবহার হউক। প্রয়োজনে আইন করে হলেও যেন মোবাইলের ব্যবহার সীমিত করা হয়। শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে মোবাইলের বিকল্প হিসাবে বই তুলে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
চলছে ভাষার মাস। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই একুশ আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার। ফেব্রুয়ারিজুড়েই চলবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাঙালির প্রাণের মেলা। এই মাস হউক বইয়ের প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশের অঙ্গীকারের মাস। আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে হাতে বই তুলে দেয়ার মাস। বইকে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার মাস।