
কবি শাহেদ কায়েসের কবিতা একই সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য, মাটি, মমতার কথা বলে। কবিতাগুলো এমন যে, খুঁড়ে পাওয়া আত্মা-নদীর স্বাদ ফুটে ওঠে কবির আপন শৈলীর শৈল্পিক চিত্রে। প্রচল যাপনকে পাশ কাটিয়ে জীবনভর সংগ্রামে ব্রত এ কবির কবিতায় সংগ্রামও কম হয়ে উঠে আসে না। জনপদের শ্রম, ঘাম নিপুণ ছাকনিতে তিনি তুলে আনেন শব্দের অসীম ব্যঞ্জনায়, বিশ্বাস ও বিশালতায়।
শাহেদ কায়েসের সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়ায়’ আমরা দেখি, তিনি বলছেন তাঁতের কথা, তাঁতির কথা, একটি জনপদের একাগ্র জীবনাংশের কথা। তিনি লিখছেন-
‘হাত চলে, পা চলে/ তাঁত চলে, তাঁত চলে.../ নিজস্ব সৃজনে ভরে ওঠে জমি/ স্বচ্ছ ভূমির উপর গাঙের বাতাস/ বাতাসে মেলে ধরো জমিন, স্পষ্ট/ হোক গাঢ় সুতোয় তোলা নকশা/ ভাতের মাড়ের ম ম ঘ্রাণ/ ফুল-নকশা জ্যামিতিক কষ্ট/ নাচতে-নাচতে সুতোয় লাছি/ ঘোরে চরকা, নাটাই হচ্ছে সুতো/ শীতলক্ষ্যায় জেগেছে জোয়ার / মাকু মারো, মাকু মারো মিয়া/ বাইনে বাইনে ভরে উঠুক শরীর/ তোমার মধ্যমা আর তর্জনীতে/ কী জাদু তাঁতি! পা চলে, হাত চলে/ জীবনের তাঁত চলে, তাঁত চলে...’ (পারিওয়ালী)।
আসলেই তো এই পড়ি-মরি যাপন-যৌবনে, জীবনের গলিঘরে জীবনটা কি রূপকে তাঁত নয়! নয় কি ইতিহাসের সেই পল্লি! তাঁতের মাকু, ববিন, চরকা, নলি নয়? তীব্র জোরে মাকু মেরে মরে যেন ফেলতে হয় আমাদের প্রত্যাহিক যোগ-বিয়োগের প্রতিটি পা, তীব্র প্রতিযোগী সময়ের চর পেরিয়ে যেতে করতে হয় অনাহূত যুদ্ধ। তবু সেই বিলুপ্তপ্রায় তাঁতিদের মতো ক্রমেই কি হেরে যাচ্ছি না আমরা? তলিয়ে যাচ্ছে না কি আমাদের বুননের মধুর মিউজিক? শাহেদ কায়েস হেরে যেতে নয়, জিতে উঠতেই দিচ্ছেন ডাক- ‘মাকু মারো, মাকু মারো/ বাইনে বাইনে ভরে উঠুক শরীর।’
একে একে কবিতাগুলো পাঠে প্রত্যক্ষ করি, একই সঙ্গে প্রগাঢ় এক বোধ কিংবা তীক্ষè খেয়ালের সরু রাস্তাও তার আঙুল থেকে ফসকে যায় না। তিনি অভিজ্ঞানের বিস্তীর্ণ জমিন চষে, প্রত্যক্ষণের আবহমানতা পিয়ে চিমটি চিমটি করে চলন রেখার সূক্ষ্ম তিল তুলে প্রদর্শন করেন দৃশ্যত সমিরে, যদিও তা এক আড়াল তৈরি করে অব্যক্ত নৈতিক বেদনার ফুল ফুটায় মানুষেরই অন্তর্জামের নিকটবর্তী হয়ে। ফলে তার কবিতায় দেখি, তিনি একটি ছবি আঁকছেন গভীর সূত্র ব্যবহার করে, একটা আয়না তৈরি করছেন পাঠকের সম্মুখে, যেখানে চট করে দেখে ফেলা যায় না প্রতিবিম্বটা। ধরা যায় না রংটা, রূপটা; চিহ্নিত করে দেখান ক্ষত, গর্তগুলো কিন্তু স্পষ্ট বলেন না; খানিক বুঝতে ভাবতে হয়-
‘রাস্তা বাড়িয়ে দিয়েছে পা, নিম বিছানো পথে/ রাস্তা থেকে পথ-/ অহেতু কোলাহল থেকে গভীর নির্জনে.../ অরণ্যের সান্দ্র হাওয়ায় ফুটে আছে ভেজাস্বর/ মধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে উড়ছে নিমফুল মহাশূন্যে।/ ছায়ার ভারে বেঁকে যাচ্ছে পা, পথের নিশানা/ প্রতিটি পথের বাঁকে প্রতীক্ষায় থাকে-/ কোনো না কোনো গন্তব্য।’ (রাস্তা ও পথ)
কবি যে সংগ্রাম আর মিছিলের চৌরাস্তায় হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে আপন আত্মার উড়ন পাখি, পাখি-মরমের গানেও নিমগ্ন নিজের সঙ্গে, নিজের সামনেও যে নিজে এক প্রশ্ন, সে পরিচয়ও পেলাম এবারের বইটিতে। তাকে জানলাম আরেক অভ্যন্তরের অক্ষরে; কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এক স্তরে পাই- মানুষের মর্মে আরেক মানুষের সহজ মানুষরূপে। যে মানুষটি হয়তো অনেকের মধ্যে থাকে কিন্তু অহরহ মানুষের মধ্যে থাকে না। প্রবঞ্চক আর প্রতারক দুনিয়ায় এই সহজ মানুষের স্বরে মুগ্ধ হই, যখন পড়ি-
‘প্রকাশ্য পথ, পথের বাঁকে অদৃশ্য পথ/ চলতে চলতে একাকার-/ পথ ও পথিক/ তোমার যত ঋণ বৃক্ষ, পাখি, নদীর কাছে/ কোন পথে যাবে তুমি, বলো তো কায়েস!/ আকাশ যেদিন ব্ল্যাকবোর্ড, হেঁটে হেঁটে/ নিমফুল ঝরা পথে, সন্ধ্যা নদীর তীরে/ যেতে চাই নিঃশব্দে চলা সময়ের কাছে।’ (পথ)
এই নিঃশব্দের কাছে, শূন্যের কাছে, সত্য এক সময়ের কাছে পৌঁছার আবেদন নিজের সমীপে- এখানেই শাহেদ কায়েসকে অনুধাবন করি অভিন্নতার ভেতর ভিন্ন দেখায়। রাষ্ট্র কিংবা সমাজ, ব্যক্তি কিংবা পরিবার- তিনি যেন বহুকাল থেকে হাঁটা একজন পথিক- যিনি পড়তে পারেন মানুষ, মন, তারও ভেতরের আর্তনাদ, আহ্লাদ। অঙ্কন করতে পারেন সঠিক ছবিটা। যা আমাদের দেখার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থটির ৫৬টি কবিতায় এই কবিকে পাওয়া যায় প্রকৃতির নির্মোহ সন্তানরূপে, বিচক্ষণ পর্যটক রূপে, ধ্যানি পর্যবেক্ষক ও দ্রোহের জ্বলনকাঠি হিসেবে। যদিও তার বিদ্রোহটা বখাটের বাড়তি বিন্যাসের মতো না। তবে আঘাতের সুরটা সুতীব্র।
একঘোরে সব কয়টি কবিতা শেষ করে যতটুকু আবিষ্কার হলো- বলতে এসে মনে হলো, বলা হলো না প্রায় কিছুই। বলার লোভে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন নয়, বরং শাহেদ কায়েসের কাব্যবইটি বিস্তর আলাপের দাবি রাখে। নিকট সময়ে আরও লিখব, লিখতে হবে; একটি ভালো বই সেই তাড়নাটি তৈরি করে, নিশ্চয়ই তার নিজস্বতায়। আশা করি, যারা পাঠক, যারা কবিতায় খোঁজেন জীবন বা জীবনের-দৃষ্টি তাদের ভালো লাগবে এর কবিতাগুলো।