
ভাবনা এবং ভাষা। শব্দ এবং বিষয়ের দিক থেকে মনে হয় দুটো আলাদা। কিন্তু তাদের মধ্যে আসলে একটি সম্পর্ক আছে। শব্দের আলাদা আলাদা অর্থে সম্পর্কটি শুনতে সরল হলেও বাস্তবে অতটা সরল নয়; একটু জটিলই বলা যায়।
ভাবনা যখন ভাষায় রূপ নেয়, তখন তা কেবল শব্দের সমষ্টি নয়, বরং একটি অর্থ প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভাবনা কি ভাষার আগে জন্ম নেয়, নাকি ভাষাই ভাবনাকে গঠন করে যায়? তাহলে ভাবনার সীমানা কোথায়, ভাষার সীমাবদ্ধতা কতটুকুতে থেমে যায়!
আমরা কি সত্যিই নতুন কিছু ভাবতে পারি? নাকি কেবল পুরনো কথাগুলোকেই নতুন করে রূপ দিই? প্রতিটি ভাবনা কি তাহলে আগের ভাবনার নিছক পুনরাবৃত্তি মাত্র?
প্লেটো বলেছিলেন, সব জ্ঞানই স্মৃতির পুনরাবৃত্তি। হেগেল সেটাকে ভিন্নভাবে বলেছিলেন, ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়, কিন্তু প্রতিবার সেটা হয় নতুন ব্যাখ্যায়।
মানুষ তার কথাগুল বলতে চায়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিচিত্র সামাজিক মাধ্যমের যুগে বেশিরভাগ মানুষ এখন কোনো না কোনোভাবে তার চিন্তা প্রকাশ করতে পারে। মত প্রকাশ মানেই তার ভাবনাটি বলা। কিন্তু একটি প্রশ্ন আসে- সব মতামত কী মৌলিক, নাকি কেবল একই মতের একই ভাবনার শব্দগত ভিন্ন রূপ। শব্দের বাহার যতই বদলাক, ভাবনার মূলধারা কি আসলে বদলায়?
এখন তথ্য এবং প্রকাশের মাধ্যমগুলো সহজলভ্য। এতে ভাবনা এবং ভাষার সম্পর্কটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। আজকাল প্রত্যেকেরই কথা বলার, লেখার এবং প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বা কীবোর্ডের সামনে বসে যে কেউ নিজের ভাবনা প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু এই সহজলভ্যতা কি ভাবনার গভীরতাকে ক্ষুণ্ন করছে? নাকি এটি ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে? ভাবনা কি ভাষাকে খুলে দেয়, নাকি ভাষার ব্যবহার ভাবনায় নতুনত্ব আনে।
একদিকে প্রকাশের এই সহজলভ্যতা ভাবনার প্রসার ঘটিয়েছে, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। আগে যারা লেখক বা বক্তা ছিলেন না, তারাও এখন নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছেন। কিন্তু অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ায় ভাবনার গভীরতা এবং মৌলিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।
কারণ, বেশিরভাগ কথাই এখন একই কথার পুনরাবৃত্তি।
বেশিরভাগ কথা এখন অর্থে একই, শুধু শব্দের সজ্জায় ভিন্ন। শব্দের এই সজ্জা বাক্যকে ভিন্ন করে, কিন্তু অর্থকে তেমন বদলায় না। এখানে ভাষার একটি সংকট দেখা দেয়। ভাষা যখন ভাবনার গভীরতাকে ধারণ করতে পারে না, তখন তা কেবল শব্দের খেলা হয়ে দাঁড়ায়।
এই সংকটের মূলে রয়েছে ভাবনা এবং ভাষার মধ্যে একটি ফাঁক। ভাবনা যখন ভাষায় প্রকাশ পায়, তখন তা সম্পূর্ণরূপে ধরা দেয় না। ভাষা কখনোই ভাবনার সমস্ত গভীরতা এবং সূক্ষ্মতা প্রকাশ করতে পারে না। এই ফাঁকটি চিরকালই ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে এটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। কারণ, আজকাল ভাষার ব্যবহার এতটাই সাধারণ হয়ে গেছে যে, তা ভাবনার গভীরতাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
শব্দের শক্তি চিন্তাকে রূপ দেয়। আবার চিন্তাই শব্দের জন্ম দেয়, কিংবা দিতে পারে। কিন্তু শব্দ কি সব সময় চিন্তার মৌলিক বা আসল রূপ ধরে কিংবা ধরতে পারে?
আমরা জানি যে - একই সত্য হাজারো ভাষ্যে ধরা দিতে পারে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা বলতেন, ‘সবাই যখন একই কথা বলে, তখন হয় সেটি সর্বোচ্চ সত্য, নয়তো সর্বোচ্চ মিথ্যা।’
আজকের পৃথিবীতে যেখানে তথ্যের প্রবাহ অবিরাম, সেখানে সত্যও ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। একেকজন একেকভাবে বলেন, কিন্তু অধিকাংশ সময় মূল বক্তব্য যেন একই থাকে।
ভাষা কি কেবল ভাবনার প্রকাশ? এটা ঠিক যে, ভাষা হলো ভাবনার একটি টুলস বা মাধ্যম। কিন্তু এই মাধ্যমটি যদি ভাবনার গভীরতাকে ধারণ করতে না পারে, তাহলে তা কেবল শব্দের স্তূপে পরিণত হয়। শব্দের নতুন সজ্জায় কেবল নতুন বাক্য হয়, কিন্তু ভাবনার গভীরতা না থাকলে সে বাক্য একই কথায় রয়।
এক্ষেত্রে দর্শন একটি প্রশ্ন করে- কোনো কথা কি একেবারে স্পষ্ট হতে পারে? লাও জু বলেছিলেন, ‘যা প্রকাশ করা যায়, তা প্রকৃত সত্য নয়।’
অনেক সময় ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে ভুল ধারণা কেবল শব্দের স্তূপে পরিণত হয়।
আজকের যুগে তথ্যের আধিক্য মানুষকে সত্যের কাছাকাছি না এনে বরং বিভ্রান্ত করছে। ফুকো দেখিয়েছেন, ক্ষমতা যাদের হাতে, সত্যও তাদের দখলে থাকে বেশিরভাগ সময়। ফলে সত্যের নামে প্রচারিত বহু কথা আসলে ক্ষমতার ভাষ্য মাত্র। আসল কথা চাপা পড়ে থাকে অস্পষ্টতার আড়ালে, ভুল কথার পাহাড় তৈরি হয় আরও বেশি তাতে।
তাহলে কি এতো কথার মাঝে সত্যিই কি নতুন কিছু নেই? সব কি কেবল পুনরাবৃত্তি? উত্তর হতে পারে- আংশিক হ্যাঁ, আংশিক না।
নতুনত্ব আসে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে। কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘পুরনো চিন্তা নতুন দৃষ্টিতে দেখাই আসল জ্ঞান।’ নতুনত্ব মানে শুধু নতুন শব্দ নয়, একটি নতুন উপলব্ধি।
আমরা যদি কেবল শব্দ বদলাই, তবে ভাবনার আসল রূপ বদলায় না। কিন্তু যদি দৃষ্টিভঙ্গির গভীরে যাই, তবে পুরনো কথার মধ্যেই নতুন সত্যের জন্ম হয়।
লেখকের দায়িত্ব কি শুধু নতুন শব্দ তৈরি করা? নাকি নতুন করে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি করা? গভীর চিন্তা কখনো শব্দের বাহুল্যে হারিয়ে যায় না, তার মূল শক্তি প্রকাশ পায় স্পষ্টতার মধ্যে।
সত্যের অনুসন্ধান কখনো থামে না, থামা উচিত নয়। প্রতিটি নতুন ব্যাখ্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরও গভীর প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্নই চিন্তার আসল শক্তি। যেখানে প্রশ্ন, সেখানেই জ্ঞান।