ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩১

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

প্রদীপ দত্ত

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

বাংলার মায়াভরা পথে হাঁটতে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই হয়তো তিরাশি বছর বয়সে এসে থেমে গেলেন। বয়সের ভারে কিছুটা শীর্ণ দেহ, পেছনে এলিয়ে দেয়া কিছুটা লম্বা শুভ্র চুল, চশমার আড়ালে তেজোদীপ্ত একজোড়া চোখ, বাংলা গানের এক মহিরুহ স্বপ্নবাজ মানুষ, বার্ধক্যের আঙিনায় দাঁড়িয়ে তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে অনন্তলোকে চলে গেলেন। আসছে বর্ষায় আর তো গাইবেন না ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর হৃদয় ভরে বান/আকাশ বাতাস ছেয়ে রয়েছে রবিঠাকুরের গান।’ পেছনে ফেলে আসা এই এতগুলো বছরে তিনি ছিলেন এক অদম্য পথিক। বাংলা গানের জগতে প্রথা ভেঙে নতুন পথ সৃষ্টির মোহ যাদের মাথায় চেপে বসেছিল তাদেরই একজন ছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। পূর্বসূরি প্রয়াত হেমাঙ্গ বিশ^াস, সলিল চৌধুরী, ভূপেন হাজরিকা, সত্যেন সেন এঁদের চোখ দিয়ে তিনি বাংলাকে দেখেছিলেন। দেখেছিলেন বাংলার গণমানুষ তথা প্রান্তজনের জীবন, তাদের স্বপ্ন আর দ্রোহ, সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে চলা এসব মানুষের জন্যই ছিল তাঁর গান। গত শতকের শেষ কয়েকটি দশকে এক নতুন ধারার গান নিয়ে তিনি সাগরে ডিঙ্গা ভাসিয়েছিলেন। নিজে গান লিখেছেন ছড়া-কবিতায় সুর দিয়েছেন আবার নিজ কণ্ঠে দৃপ্ত উচ্চারণে গেয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন দর্শক শ্রোতাদের সামনে। এক ব্যতিক্রমী গায়কী ছিল তার পরিবেশনায়। প্রায় খালি গলাতেই কোনরকম যন্ত্রের অনুষঙ্গ ছাড়াই তিনি স্বচ্ছন্দে গান গাইতেন। কখনো হাততালি দিয়ে কিংবা হাতে তুড়ি দিয়ে দু’হাত সামনে প্রসারিত করে গণসংগীতের আবহে গাওয়া তাঁর গান শুনে শ্রোতারা সহজেই আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। তাঁর গাওয়া গানগুলোতে কথা আর সুরের বহুমাত্রিক চলনে এক অসামান্য ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হতো। সভা-সমিতি পদযাত্রায় এই গানগুলোতে ছিল সমাজকে বদলে দেয়ার স্বপ্ন। বদ্ধ চেতনায় ঘা মেরে জাগিয়ে দেবার আহ্বান। বাংলা ছিল তার গানের ভাষা, দ্রোহের ভাষা, স্বপ্ন দেখার ভাষা। তাই তিনি নিজেই গেয়েছেন ‘বাংলা আমার দৃপ্ত সেøাগান-ক্ষিপ্ত তীর ধনুক’। তাঁর গানের এক একটি লাইন যেন এক একটি সেøাগান, এক একটি পোস্টারের ভাষা। জীবনমুখী গানে তাঁর গানগুলো ছিল নবতর সংযোজন।
অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি ১৯৪২ এর ২৫ জুন তারিখে। বাবা প্রভাত চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্কুল মাস্টার। মা বীনাপানী দেবী সাধারণ গৃহিণী। সাতচল্লিশের দেশভাগের কিছু পরে পরিবারের সঙ্গে পশ্চিম বাংলায় চলে যান। বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। হুগলি জেলার চুচুঁড়াতে কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছেন। পেশাগত জীবনে কলেজে পড়িয়েছেন, ব্যাংকে চাকরি করেছেন। প্রথাগত সংগীত শিক্ষার ধার কাছ দিয়েও যাননি। তবে গান ছিল তার হৃদয়ের চেতনার বহিঃপ্রকাশ! নিঃসন্দেহে তিনি এক অনন্য প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন। বারো বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতায় প্রথম সুর দিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে সুকান্ত ভট্টাচায, বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ, অন্নদাশঙ্কর রায়, কবি আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতায় সুরারোপ করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ‘প্রথমে গান আমি লিখতে পারতাম না। এদিক ওদিক কবিতায় সুর দিতাম। সুর দেওয়াটা আমার সহজাত ছিল। কিন্তু নকশালবাড়ী আন্দোলন আমাকে গীতিকার করেছে। ওরা যে ‘তিনটি প্রবন্ধ’ পড়ে সেখানে নানা রকমের তত্ত্ব আছে, কোটেশন আছে, এগুলো কি পড়ে পড়ে শোনাবে? ভাবলাম এগুলো যদি গান করে শোনান হতো, তাহলে সহজে বোঝানো যেত। মাও সেতুং বলেছেন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সমস্ত মৃত্যু সমান নয়। সেখান থেকেই লিখলাম ‘জন্মিলে মরিতে হবে রে জানে তো সবাই/তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই রে/সব মরণ নয় সমান/ জীবন উৎসর্গ করে সর্বহারা জনতার তরে মরণ যদি হয়/ওরে তাহার ভারে হার মানে ঐ পাহাড় হিমালয় রে- সব মরণ নয় সমান’। এর পর তার সবচেয়ে বিখ্যাত গান ‘আমি বাংলায় গান গাই’ তিনি লিখেছিলেন বাংলা ১৪০০ সালের ১ বৈশাখ তারিখে। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ ও এই গানটি ‘যেতে হবে’ শিরোনামের অ্যালবামে আসে ১৯৯৪ সালে। তার গানের প্রথম অ্যালবাম ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা লং মার্চ-বন্দি মানুষের গান সুরারোপ করেছিলেন ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন/আগুন হাতে দ্যাখোরে মানুষ নাচে/আগুনের মত লাল হাজার হাজার লাল পতাকা/রাত শেষে বন্দির চোখে নাচে/দ্যাখোরে স্বপ্ন নাচে’এই গানগুলি তিনি উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছিলেন। মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে বামপন্থার পথে হেঁটেছেন। অনেকেই বলে থাকেন নকশালপন্থি কমিউনিস্ট ধারার কাছাকাছি ছিলেন। আবার পশ্চিম বাংলায় মার্কসবাদী শাসনামলে তাদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের সময় কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সব পরিচয়ের আড়ালে তিনি একজন কমিটেড আর পরিবর্তন পিয়াসী মানুষ ছিলেন একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা চলে। নিজের সম্পর্কে কোন কিছু বলতে তিনি অকপট ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ‘কিছু মানুষ আছেন যারা কাঠামোর বাইরে যেতে চান। তাঁদের নাম হয় না, তাঁরা ব্যর্থ হন। নিজেরা প্রচারের আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন। আমি কি করছি জানি না। কি ভাঙছি তাও জানি না। কারণ যেটা আছে সেটা সম্পর্কেই তেমন কোন ধারণা নেই’ ।
তবে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি সব শ্রেণির শ্রোতাদের কাছে আদৃত হয়। গানটি পশ্চিম বাংলার সীমানা পেরিয়ে গত শতকের নয়ের দশকে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবুর কণ্ঠে তৎকালীন একুশে টেলিভিশনে নিয়মিত দৃশ্যায়িত হয়ে প্রচারিত হতে থাকে; যা সে সময় অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। মূলত প্রতুল মুখোপাধ্যায় নামটির সাথে আমাদের পরিচয় সেখান থেকেই। একই দশকে তাঁর আরও কিছু গান জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে তাঁর তৃতীয় গানের অ্যালবাম ‘ওঠো হে’ ১৯৯৭ সালে চতুর্থ অ্যালবাাম ‘কুট্টুস কাট্টাস’ বাজারে আসে। এই অ্যালবামগুলোর বেশকিছু গান জনপ্রিয় হয়। যেমন ‘খিলখিলির মুলুকেতে’ ‘রাগ করো না’ ‘ভয় পাস না ছেলে’ ‘খোকন দিল সাগর পাড়ি’ ‘শোন বন্ধুগণ’ ইত্যাদি। তাঁর ‘যেতে হবে’ অ্যালবাম সেখানে একটি বিখ্যাত গান ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে/ সাথীরে ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে/পূবের আকাশ রাঙা হ‘ল সাথী ঘুমায়ওনা আর জাগরে/ ডাঙার টানে পরান ছিল বাঁধা কেন রে বন্ধু এতকাল/ গরজি গুমরি ডাকে শোন ঐ তরঙ্গ উথাল পাথাল/ পাল তুলে দাও হাল ধরো হাতে দুস্তর সাগর হবো পার’। ঐ একই অ্যালবামের একটি বিখ্যাত গান সমীর রায়ের লিখা ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি/বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি’। সব কিছু প্রয়োজনে বেচে দিলেও গানের কথায় আছে ‘বুকের জ¦ালা বুকেই জ¦লুক কান্না বেচো না’ ‘বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না’ আবার বলছেন ‘হাতের কলম জনমদুখী তাকে বেচো না’।আমাদের সমাজে নিত্যদিনের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দেয়া পরাজিত আপোসকামী মধ্যবিত্ত চরিত্রের মানুষজনকে উদ্দেশ্য করে লিখা এই গানের আবেদন কখনো ফুরোবে না। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ, রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিটেমাটি হারিয়ে দেশান্তরী হওয়া দুই বাংলার মানুষ তথা বাঙালিদের মনে এক স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে। এর ফলে একই ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ এক অদৃশ্য সীমানা প্রাচীর দিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে রয়েছে। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটা গানের অ্যালবাম ‘আমি বাংলার গান গাই’ ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় যার একটি অসাধারণ গান ‘দুইজনাই বাঙালি ছিলাম দ্যাখো দেখি কান্ডখান/ তুমি এখন বাংলাদেশী আমারে কও ইন্ডিয়ান/ দুঃখ কিছু ছিল মনে দুঃখেরে কই যাও রে ভাই/ সাঁঝবেলায় আদরের ডাকে কেমনে বল মুখ ফিরাই/ চল মন মা-বাবার ভূমি দেখি নিজের ভাই-বোনে/ শুনছি নাকি তারা আজি এই পাগলের গান শোনে/ দুইজনাই বাঙালি বন্ধু বাংলা দুইজনারই জান/ দুইয়ের মুখে বাংলা কথা দুইয়ের গলায় বাংলা গান’।
বায়ান্নর মহান একুশের সংগ্রাম আজ শুধু বাঙালির নয় পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের অর্জন। প্রতুল মুখোপাধ্যায় কবি আল মাহমুদের একটি কবিতায় সুরারোপ করে গেয়েছেন যা ‘আমি বাংলার গান গাই’ অ্যালবামের অন্যতম একটি গান। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার ওয়াক্ত/ বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায় বরকতেরই রক্ত’। একই কবিতার শেষ দুটো লাইন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের অনন্য সুর আর কণ্ঠের যাদুতে আমাদের সবাইকে একুশের ভোরের পদযাত্রায় নিয়ে যায়Ñ‘প্রভাতফেরি প্রভাতফেরি আমায় নেবে সঙ্গে/বাংলা আমার বচন আমি জন্মেছি এই বঙ্গে’।

×