ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩১

কালো ঘোমটার নিচে

রফিকুর রশীদ

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৭:১৩, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কালো ঘোমটার নিচে

‘ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া’ বাইরের জগতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বাঙালির খুব বেশিদিনের নয়। ফলে ভ্রমণ-সাহিত্য বলে বিশেষ কিছু আমাদের বাংলা ভাষায় সেভাবে গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। তবে এখানেও প্রণম্য সেই রবীন্দ্রনাথ, বাঙালির বটবৃক্ষ। পথ কেটে দিয়েছেন ঠিকই, যোগ্য পথিকের দেখা মেলেনি খুব বেশি।
পারিবারিক সূত্রধরে ২০১৮ সালে তিন মাসের জন্য আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় অচেনা এক দেশ জাম্বিয়া ভ্রমণের সুযোগ হয় আমার। ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ আমি আবার এসেছি এই দেশে, আরো একবার এই অরণ্যসঙ্কুল জনপদ ভালো করে দেখার জন্যে। এবারের ভ্রমণকালের মেয়াদ ছয় মাস। আফ্রিকার দেশে দেশে বর্ণবাদবিরোধী এবং উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী নেতৃবৃন্দের সাহসিকতাপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামের কাহিনীর সাথে যৎকিঞ্চিত পরিচয় আছে মাত্র, কিন্তু সেসব দেশের কোলে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কিছুই জানা নেই। বরং মনের ভেতরে বাসা বঁধে আছে আফ্রিকা সম্পর্কে প্রচলিত এবং অজ্ঞতাপ্রসূত নানান অপবিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আফ্রিকা বিষয়ক কবিতার পাঠ আমার ভেতরের অপবিশ্বাস সমূলে উৎপাটন করতে পারেনি। বুকের গভীরে সেই জমাট অন্ধকার নিয়ে ২০১৮ সালে নভেম্বরের শুরুতে এবং ২০২৪ সালে এপ্রিলের শেষে জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা বিমানবন্দরে যখন নামলাম তখন উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে আফ্রিকার আকাশ, আমি মনে মনে গুনগুনিয়ে উঠি—
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে...।’
ক্রিকেট খেলার জনপ্রিয়তার সুবাদে জিম্বাবুয়ের যে পরিচিতি আছে দুনিয়াজোড়া, পার্শ্ববর্তী দেশ জাম্বিয়ার তেমন পরিচিতি নেই। জাম্বিয়া বললে তাই অনেকে জিম্বাবুয়ে বলে ভুল করে। তবে হ্যাঁ, এ দুটি দেশ যেনবা একই বৃন্তে দুটি কুসুম, একই মায়ের যমজ সন্তান। ১৯৬৪ সালের পূর্বে খরস্রোতা জাম্বেজি নদীর দুই পারের এই দুই দেশ ছিল রোডেশিয়া নামের একই দেশ। আমাদের এই বাংলাদেশের (তথা ভারতবর্ষের) মতো আফ্রিকান এই দেশ দুটিও দীর্ঘকাল শাসিত হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে। সিরিল রেডক্লিফের ভেদবুদ্ধির ছুরিতে ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্টে বাংলা যেমন দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সঙ্গে শেকলবন্দি হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ব্রটিশ শাসনমুক্ত হবার সময় (১৯৬৪ সালে) প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবাধ লীলাভূমি রোডেশিয়া দুভাগ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম দুটি রাষ্ট্র জাম্বিয়া (রাজধানী লুসাকা) আর জিম্বাবুয়ে (রাজধানী হারারে)। আমরা জানি স্বাধীনতাকামী বাঙালি কবি অন্নদাশংকর রায় বাংলা ভাঙার বেদনায় প্রতীকী পরিহাস করে ছড়া লেখেন— ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ কর...।’ কিন্তু রোডেশিয়া ভাঙার দুঃখে আফ্রিকান কোনো কবি এমন তীব্র কটাক্ষপূর্ণ এবং বেদনাদীর্ণ কবিতা লিখেছেন কিনা আমার জানা হয়নি। তবে জাম্বেজি নদীবিভাজিত এই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমৎকার সুসম্পর্ক বিরাজমান আছে স্বাধীনতার পর থেকেই।
লুসাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম রেখেছে জাম্বিয়ার স্বাধীনতার স্থপতি কেনেথ কাউন্ডার নামে। তাঁর নামে আরো কিছু কিছু স্থাপনার নামকরণ এবং তাঁর আবক্ষ ভাস্কর্য পরে আমি দেখেছি। কেনেথ কাউন্ডার রাজনৈতিক দল ইউএনআইপি তখন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে, তবু তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানাতে কারো কোনো দ্বিধা নেই দেখে এ দেশের কালো মানুষদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা জাগে। বিমানবন্দরের বাইরে এসেই আমার চোখ জুড়িয়ে যায় মনমাতানো কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্যে। কোথায় দূর ভারতবর্ষের কৃষ্ণ, তারই এমন আধিপত্য আফ্রিকায়! তবে কি অদূরে কোথাও রাধাও আছে! কৃষ্ণচূড়ার পাশে রাধাচূড়াও আছে আমাদের দেশে। বেচারা কৃষ্ণ এখানে একাকী থাকতে পারে! খানিকটা এগিয়ে দেখি রাস্তার দুপাশে হালকা নীলাভ বেগুনি রঙের জাকারান্ডা ফুলের ঝাড়। যত দূর চোখ যায় জাকারান্ডার সমারোহ। বিমান থেকে নামার পর উতল হাওয়ায় ভেসে চলেছি। মাথার উপরে চনমনে রোদ, কিন্তু গায়ে কোনো ঘাম নেই, রোদে তেমন তাপ নেই; জানা গেল — নভেম্বরে এখানে গ্রীষ্মকাল, মাস খানেকের মধ্যেই বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা। গায়ে চড়ানো শীতবস্ত্রের দিকে তাকিয়ে নিজেরই তখন হাসি পায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ফুট উচ্চতার শহর লুসাকায় বছরের অধিকাংশ সময়েই থাকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, সে কথা আমার আগে জানা ছিল না।
চারিদিকে স্থলাবদ্ধ দেশ জাম্বিয়া আয়তনে বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় সাত গুণ হলেও জনসংখ্যা দুই কোটিরও কম। এই দেশটিকে ঘিরে আছে আটটি আফ্রিকান দেশÑ তাঞ্জানিয়া, মালাউই, মোজাম্বিক, জিম্বাবুয়ে, বৎসোয়ানা, নামিবিয়া, কঙ্গো এবং অ্যাঙ্গোলা। জাম্বিয়া মোট নয়টি প্রদেশে বিভক্ত। লুসাকা নামেও আছে একটি প্রদেশ। সারা দেশের এবং লুসাকা প্রদেশের রাজধানী শহরের নামও লুসাকা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই শহরটি একেবারে ঝকঝকে তকতকে, বড়ই পরিচ্ছন্ন। আমাদের পার্বত্য শহর চট্টগ্রামের মতো এই লুসাকাও অনেকগুলো পাহাড়ের মাথার উপরে অবস্থিত। প্রশস্ত রাজপথ অতিশয় পরিচ্ছন্ন। সারাদেশের লোকসংখ্যা দুই কোটির নিচে হলেও রাজধানী শহরে প্রায় পঞ্চাশ লাখেরও অধিক মানুষের বাস। আর সেই সঙ্গে আছে বহিরাগত অগণিত মানুষ। আমার তো মনে হয়েছে লুসাকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই বাইরের মানুষ, বিভিন্ন কারণে জাম্বিয়ায় এসেছেন এবং তাদেরও অধিকাংশ লুসাকায় বাস করেন। বহিরাগত সাদা চামড়ার মানুষদের সহজে চেনা গেলেও কালো চামড়ার বহিরাগতের সংখ্যা একেবারে কম নয়, তবে তাদের শনাক্ত করা কঠিন। সব প্রদেশের সঙ্গে তো বটেই, লুসাকার সঙ্গে প্রতিবেশী আটটি দেশেরই আছে সড়কপথে চমৎকার যোগাযোগ। পাহাড়ি এলাকা বলেই সমতল ভূমি অপেক্ষা অনেক উঁচু-নিচু রাস্তা, তবে যেমন প্রশস্ত তেমনই মসৃণ। পণ্যবাহী যানবাহন অথবা প্রাইভেট পরিবহন যা-ই হোক, ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিবেগ প্রায় সব গাড়িতে সব সময়ই থাকে। আমরা একবার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত দেখতে গেলাম লুসাকা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরের লিভিংস্টোন শহরে মাত্র সাড়ে চার ঘন্টায়, ফোর হুইলার ল্যান্ডক্রুজার ছিল আমাদের বাহন। রাস্তা কতটা ভালো হলে এটা সম্ভব সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
পাহাড়-পর্বতে ঘেরা বিশাল স্থলভাগের দেশ জাম্বিয়ায় ছোট ছোট পাহাড়ি নদীও যেমন অনেকগুলো আছে, তেমনি লেকও আছে অনেকগুলো। তার মধ্যে লেক-কারিবা সব চেয়ে বড়ো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে এর অবস্থান। দৈর্ঘ্যে ২০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এটাকে বলা হয় মানবসৃষ্ট বৃহৎ লেক। লুসাকা থেকে ২৭৫ কিলোমিটার দূরে সিয়াভোঙ্গা জেলায় অবস্থিত লেক কারিবা। ভালো রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলেছে দ্রুত গতিতে। সামনে থেকে কত রকমের যানবাহন যে আমাদের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, সব খেয়াল করাও যাচ্ছে না। চমকে উঠি ৩০ চাকার বিশাল ট্রাকে গোটা দশেক টয়োটা-মার্সিডিজ-ল্যান্ডক্রুজার বয়ে আনতে দেখে। ট্রাকের সামনে ইংরেজিতে প্ল্যাকার্ড লেখা ABNORMAL LOAD। জানা গেল পার্শ্ববর্তী দেশ জিম্বাবুয়ে কিংবা তাঞ্জানিয়া বা আরো একটু দূরের দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও স্থলপথেই এভাবে নানা রকম ভারী ভারী জিনিসপত্র এ দেশে আসে। আরো অবাক হয়েছি তেলবাহী ট্র্যাংকলরির মতো মদবাহী ট্র্যাংকলরিকেও প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় চলাচল করতে দেখে। আমাদের মতো চায়ের দোকান রাস্তার পাশে নেই, আছে লিকারসপ। সেখানে লরি এসে ঢেলে দিয়ে যায় দেশি মদ, আর সে দেশের মানুষ মনের আনন্দে তা পান করে। এ দেশের পথে পথে এত যে দ্রুতগতির যানবাহনের চলাচল, যানযটের ঘটনা চোখে পড়েনি বললেই চলে। ট্রাফিক পুলিশ যে কোথায় আছে তা চোখে পড়ে না, কিন্তু ট্রাফিক আইন সবাই মানছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সিগন্যালবাতি না মানলে সেই গাড়িকে ধরা পড়তেই হবে রিমোট ক্যামেরার কল্যাণে।
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত জাম্বিয়ার সাউদার্ন প্রভিন্সের রাজধানী ও জেলা শহর লিভিংস্টোন থেকে সামান্য কিছু দূরে মশিও টুনিয়া ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে প্রবহমান। স্কটিশ ডাক্তার ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পরিব্রাজক এবং ধর্মপ্রচারক। আফ্রিকার দুর্গম অরণ্যে বসবাসরত আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্ম প্রচার করতে এসে তিনি ১৮৫১ সালের দিকে এই জলপ্রপাত আবিষ্কার করেন। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে জাম্বেজি নদীর জলরাশি ১১০ মিটার পাথুরে গিরিখাদে আছড়ে পড়ার সময় বিকট শব্দ হয় এবং ধূম্ররাজি উৎপন্ন হয়। বহুদূর থেকে শব্দ শোনা যায়, ধোঁয়াও দেখা যায়। আদিবাসী মানুষেরা এটাকে কোনো অপদেবতার কারসাজি বলে বিশ্বাস করে। লিভিংস্টোন সাহসের সাথে এগিয়ে এসে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য আবিষ্কারের পর মহারানী ভিক্টোরিয়ার নামে তা উৎসর্গ করেন। অসংখ্য পাহাড় বেষ্টিত এই দেশে আরও অনেক পাহাড়ি নদ নদী চলার পথে বাধাগ্রস্ত হয়ে ছোটখাটো গিরিখাদে পতিত হয়ে জলপ্রপাত সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি জলপ্রপাতই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ নিদর্শন। কিন্তু প্রশস্ততা গভীরতা এমন কি প্রতি সেকেন্ডে জলপ্রবাহের পরিমাণ- সকল বিবেচনাতেই ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত শ্রেষ্ঠ বলেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসছে এই সৌন্দর্যসুধার আকর্ষণে। একদিকে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য, অন্যদিকে মসিও টুনিয়া ন্যাশনাল পার্কে (সাফারি পার্কও বটে) জীবজন্তুর অবাধ বিচরণে ধন্য সবুজ অরণ্যসৌন্দর্য, মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে!
পাহাড়ি এই দেশে প্রায় সব প্রদেশেই আছে একাধিক ন্যাশনাল পার্ক। সবই আবার সাফারি পার্কও বটে। সব চেয়ে বড় পার্ক কাফ্যুয়ে ন্যাশনাল পার্কের আয়তন ২২৪০০ বর্গকিলোমিটার। নিবিড় অরণ্য। মাঝে মধ্যে পাহাড়ি নদীর ধারা। বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ। তারই মধ্যে খাঁচায় ঘেরা গাড়িতে চড়ে মানুষের ঘোরাঘুরি। তাঁবুর মধ্যে রাত্রিযাপন। দারুণ রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা! দেশ-বিদেশের কত যে পর্যটক সেই রোমাঞ্চের নেশায় ছুটে আসে এই কাফ্যুয়ে ন্যাশনাল পার্কে! এই পার্কের বুক চিরে চলে গেছে দুই প্রদেশের সংযোগকারী পিচঢালা মসৃণ হাইওয়ে। প্রতিটি পার্কে এবং জলপ্রপাতের কাছেই আছে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত। উচ্চমূল্যের এসব ব্যবসার মালিক কিন্তু জাম্বিয়ানদের কেউ নয়, বিদেশিরাই দীর্ঘ কাল থেকে এ দেশের অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও অনেক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী জাম্বিয়ায় নানা রকম ব্যবসা করে আসছে। বহুযুগ আগে ব্রিটিশরা এ দেশে আখ চাষ করানোর জন্য, খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি স্থান থেকে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোকজন নিয়ে আসে, বসতি স্থাপন করায়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেই গুজরাটীদের অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্য করে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে, শপিংমল শপরাইটের মালিক হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক খুলে স্বাস্থ্যব্যবসাও জমিয়ে তুলেছে। জাম্বিয়ার সাধারণ মানুষ শ্রমিক হিসেবে শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, মালিকানা তাদের নেই বললেই চলে।
রাজধানী শহরের চাকচিক্য পৃথিবীর অন্যান্য শহরের চেয়ে কম কিছু নয়, কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান এখনো মানবেতর। অথচ এ দেশের আছে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ (তাম্রসম্পদে পূর্ণ একটি প্রদেশের নাম কপারবেল্ট), আছে বৃক্ষ ও অরণ্যসম্পদ, আছে অনাবাদি বিশাল মাঠ; এমন কি আছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও, তবু জাম্বিয়ানদের দারিদ্র্য ঘোঁচে না। দুদশ কিলোমিটার ঘুরে গ্রামীণ জনগণের নাগাল পেলে তাদের চেহারা এবং ঘরবাড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝা যায় তারা দারিদ্র্যসীমার কত নিচে বাস করছে। আমার তো মনে হয়েছে তারা জানেই না যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক, এ দেশের মাটিতে নদীতে মাটির নিচে খনিতে সর্বত্র তাদেরই মালিকানা অধিকার। আমার খুব খারাপ লেগেছে স্বাধীনতার পর এখনো এ দেশের সাধারণ মানুষ বিদেশিদের দ্বারাই শোষিত হয়ে চলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বদেশি উচ্চবিত্তের বেশ কিছু শোষকেরও দেখা মেলে, চরিত্রে তারা একই। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার বদলও হয়, কিন্তু এদের ভাগ্য বদল হয় না কিছুতেই। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত আলো আজ মাটির গভীরের অন্ধকার গুহাতেও পৌঁছে গেছে, কিন্তু জাম্বিয়ান এই সব কালো মানুষের কপালে সেঁটে বসা কালিমার অন্ধকার আজো মোচন হলো না। সব শেষে আবারও রবীন্দ্রনাথেরই শরণ নিতে হয়, সেই কবে আফ্রিকা কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘হায় ছায়াবৃতা, কালো ঘোমটার নিচে অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ, উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে...।
আর কতকাল এই উপেক্ষা, কে জানে!

×