![দার্শনিক ও নান্দনিক অনুসন্ধান দার্শনিক ও নান্দনিক অনুসন্ধান](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/5-2502131131.jpg)
সৌন্দর্য- এই একটি শব্দ আমাদের মনে অনেক অনুভূতির জন্ম দেয়। এটি কখনো মুগ্ধতা, কখনো আকর্ষণ। আবার কখনো আত্মবিশ্বাস। কিন্তু সৌন্দর্যের প্রকৃত অর্থ কী? এটি কি শুধুই বাহ্যিক চেহারা, অথবা নির্দিষ্ট রূপ, কিংবা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো মানদণ্ড? না, সৌন্দর্য এর চেয়ে অনেক গভীর। এটি এমন এক শক্তি, যা আমাদের চিন্তা-চেতনা এবং আত্মার সঙ্গে জড়িত। কবি জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন, ‘যে সৌন্দর্য চোখে ধরা পড়ে না, তাকেই অনুভব করে হৃদয়।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সৌন্দর্যের সাধনা মানুষকে প্রকৃতির মধ্যে গভীরতর করে তোলে।’ প্রকৃতি তার সমস্ত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও স্বাভাবিকভাবেই সুন্দর। তেমনই প্রতিটি মানুষের মধ্যেও বাহ্যিকতার ঊর্ধ্বে রয়েছে এক স্বাভাবিক সৌন্দর্য।
সৌন্দর্যের ধারণা : ইতিহাস থেকে দর্শন
সৌন্দর্যের ধারণা যুগে যুগে বদলেছে। প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো সৌন্দর্যকে চিরন্তন ও আদর্শ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তার মতে, সৌন্দর্য হলো সত্য এবং কল্যাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্লেটো আরও বলেন, ‘সৌন্দর্যের প্রকৃত উপলব্ধি আমাদের আত্মাকে আলোকিত করে।’ অন্যদিকে অ্যারিস্টটল মনে করতেন, সৌন্দর্য হলো প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে একটি ভারসাম্য। মধ্যযুগে ধর্মীয় দর্শনের প্রভাব সৌন্দর্যের ধারণাকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গেও যুক্ত করেছিল। তখন সৌন্দর্যকে ঈশ্বরের সৃষ্টির নিখুঁত প্রকাশ বলে মনে করা হতো। কিন্তু রেনেসাঁ যুগে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সৌন্দর্যের আলোচনাকে আবার মানব কেন্দ্রিক করে তোলে। তখন সৌন্দর্য মানে ছিল মানবজীবনের আনন্দ এবং সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ।
কিন্তু আধুনিক সমাজে, বিশেষত শিল্প-বিপ্লবের পর, সৌন্দর্যের ধারণা এক সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিজ্ঞাপন, মিডিয়া এবং সংস্কৃতি বাহ্যিক চেহারার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ফ্রিডরিখ নিটশে তার Thus Spoke Zarathustra গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সৌন্দর্যের মানদণ্ড কেবল মানুষের মনের ভ্রান্ত ধারণার ফল। প্রকৃত সৌন্দর্য কেবল মনের গভীরতা থেকেই বোঝা যায়।’
সৌন্দর্যের মানদণ্ডের অত্যাচার
সমাজ নির্ধারণ করে দিয়েছে, কী সুন্দর আর কী কুৎসিত। এই নির্ধারণ একটি কঠোর মানদণ্ড তৈরি করেছে। ফর্সা ত্বক, লম্বা গড়ন, প্রতিসাম্য মুখশ্রীর এই সবকিছুই সেই মানদণ্ডের অংশ। এই ধারণাগুলো কেবল দৃষ্টির সীমাবদ্ধতাই নয়, বরং মানুষের চিন্তারও সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মনে পড়ে। তিনি তার ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে বিনোদিনীর চরিত্রে সৌন্দর্যের যে গভীর তাৎপর্য তুলে ধরেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক নয়, এটি মনের আলো এবং হৃদয়ের বিশুদ্ধতায় নিহিত। তিনি লিখেছেন, ‘যার মধ্যে সত্য সুন্দর, তার বাহিরেও সে সুন্দর।’
আসলে সমাজের এই মানদণ্ড কেবল শারীরিক বৈচিত্র্যকে খর্ব করে না, এটি আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্থিতিকেও প্রভাবিত করে। যখন একজন মানুষ এই মানদণ্ডের সঙ্গে মেলে না, তখন সে নিজেকে অপ্রতুল মনে করতে শুরু করে।
মানদণ্ডের এই অত্যাচার সম্পর্কে ফ্রিডরিখ নিটশে বলেছেন, ‘মানুষ এক সেতু, যেখানে চলমান তাই তার সৌন্দর্যের উৎস।’ কিন্তু আমাদের সমাজ সেই চলমানতাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। বরং সৌন্দর্যকে একটি স্থবির ধারণায় পরিণত করে আমরা আমাদের দৃষ্টি ক্ষীণ করেছি।
গণমাধ্যমের প্রভাব
গণমাধ্যম বারবার এক ধরনের সৌন্দর্যকেই আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। একই রকম মুখ, একই ধরনের শরীর, এবং একই রকম পোশাক। এই পুনরাবৃত্তি আমাদের চেতনায় একটি সংকীর্ণ সৌন্দর্যের ধারণা গেঁথে দেয়। মনোবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘মিডিয়া এক্সপোজার ইফেক্ট’ নামে অভিহিত করেন।
ধরুন, যদি মিডিয়া হঠাৎ করে বলার চেষ্টা করে যে স্থূলতাই সৌন্দর্যের প্রতীক, তাহলে রাতারাতি সমাজ সরু কিংবা পাতলা জিরো ফিগার নিয়ে তার মোহাবিষ্ট আবেশ ত্যাগ করবে।
মিডিয়া সৌন্দর্যের নামে যে আদর্শ তুলে ধরে, তার গভীরে থাকে নিরাপত্তাহীনতার প্রচার। ‘এই পণ্য ব্যবহার করুন, সুন্দর হবেন,’ বা ‘ওজন কমান, সুন্দর দেখাবেন’- এসবই আমাদের মনে তৈরি করে এক কৃত্রিম সৌন্দর্যের চাহিদা। অথচ সত্যিকারের সৌন্দর্য কোনো বিজ্ঞাপনের মোড়কে বন্দি নয়।
সৌন্দর্যের ধারণা আসলে মনের একটি সামাজিক অভ্যাস। ডেভিড হিউম বলেছিলেন, ‘সৌন্দর্য বস্তুর কোনো বৈশিষ্ট্য নয়, এটি পর্যবেক্ষকের মনে বিদ্যমান।’
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তার উপন্যাসে ‘আনন্দমঠ’-এ তিনি সৌন্দর্যের পাশাপাশি চরিত্রের গুণাবলির গুরুত্ব দিয়েছেন। সেখানে সৌন্দর্যের প্রকাশ কেবল বাহ্যিক নয়, অন্তরের বিশুদ্ধতা এবং সৎ গুণাবলির মাধ্যমেও হয়।
তবে মিডিয়ার প্রভাব যে কেবল নেতিবাচক তা নয়। এটি সৌন্দর্যের অন্তর্গত বৈচিত্র্যকেও উদযাপন করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু চলচ্চিত্র এবং বিজ্ঞাপনে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য তুলে ধরা হচ্ছে, যা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করছে।
সৌন্দর্যের নান্দনিক উপলব্ধি
সৌন্দর্য হলো ভারসাম্যের অনুভূতি। এটি এমন একটি ভারসাম্য যা হৃদয় এবং মনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ইমানুয়েল কান্ট তার Critique of Judgment-এ বলেছেন, ‘সৌন্দর্য হলো মানুষের উপলব্ধির একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।’
কিন্তু এই ভারসাম্য শুধু বাহ্যিক সমতা বা প্রতিসাম্য নয়। প্রকৃতি আমাদের শেখায় যে সৌন্দর্য বৈচিত্র্যে নিহিত। একটি ফুলের বাগানে প্রতিটি ফুলের রঙ, গঠন এবং সুবাস আলাদা। তবুও, একত্রে তারা এক অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। আর সে সৌন্দর্যটা তৈরি হয় পরস্পরের ভারসাম্য থেকে ।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘প্রকৃত সৌন্দর্য বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।’ রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র লিখেছেন, ‘বিপরীতে মিলনের আনন্দে জন্মায় সৌন্দর্য।’ প্রকৃত সৌন্দর্য বৈচিত্র্যে, তার ভিন্নতায়। যে চোখ ভিন্নতাকে গ্রহণ করতে পারে, সেই চোখেই সৌন্দর্যের প্রকৃত উপলব্ধি ঘটে। তাই আমাদের শিখতে হবে বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করতে। যখন আমরা বিভিন্নতাকে আলিঙ্গন করি, তখনই আমরা প্রকৃত সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা পাই।
কদর্যতার আসল চেহারা
কদর্যতা হলো সেই মানসিকতা, যা অন্যদের ছোট করতে চায়। এটি সেই মনোভাব, যা ভিন্নতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানুষের সৌন্দর্য তার হৃদয়ের পবিত্রতায়।’ কোনো মানুষ কুৎসিত নয়, কুৎসিত হলো সেই দৃষ্টি, যা সৌন্দর্যকে কেবল চেহারার সীমায় বেঁধে রাখতে চায়। একজন মানুষের ত্বকের রঙ, শরীরের গঠন বা মুখশ্রীর বৈশিষ্ট্য তার সৌন্দর্যের মাপকাঠি হতে পারে না। বরং তার চরিত্র, উদারতা এবং মানবিকতাই প্রকৃত সৌন্দর্যের পরিচয় বহন করে। একটি শরীরের আদল- এসব জন্মগত বৈশিষ্ট্য। এগুলো কোনো গুণ নয়, বরং প্রকৃতির এক নির্মাণ। কিন্তু মানুষের আসল সৌন্দর্য হলো তার মন ও কাজের পরিশীলন। নজরুল তার কবিতায় বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ মানুষের সৌন্দর্য তার মানবতায়, তার উদারতায়।
সাহিত্যে সৌন্দর্য ও নন্দনতত্ত্ব
বাংলা সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব সৌন্দর্যের গভীর ব্যাখ্যা দেয়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ দাশ কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় সৌন্দর্যের এমন এক গভীর তাৎপর্য আমরা দেখতে পাই, যা বাহ্যিকতার চেয়ে বেশি মানসিক ও মানবিক।
জীবনানন্দ দাশ তার ‘বনলতা সেন’ কবিতায় লিখেছেন:
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি, আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে।’
এই কবিতায় সৌন্দর্য হলো এক নিখুঁত অনুভূতি, সৌন্দর্য এখানে জীবনের প্রতিটি মোড়ে পাওয়া যায়। সৌন্দর্য তাই শুধু একটি দৃশ্য নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা।
সৌন্দর্যের নতুন সংজ্ঞা
আজ আমাদের সৌন্দর্যের একটি নতুন সংজ্ঞা গড়ে তুলতে হবে। সৌন্দর্য মানে কেবল নিখুঁত চেহারা নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সত্য সৌন্দর্য হলো অন্তরের গভীরতায়।’ তাই বাহ্যিকতা দিয়ে সৌন্দর্যের বিচার নয়, এটি গভীরতর অনুভবের বিষয়।
সৌন্দর্যের আসল অর্থ খুঁজে পেতে আমাদের নিজেদের দৃষ্টি বদলাতে হবে। এটি করার মাধ্যমে আমরা কেবল অন্যদের নয়, নিজেদেরও মুক্ত করতে পারব। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব সৌন্দর্য কোথাও মিশে আছে, খুঁজে নিতে হবে শুধু।’