![বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রেমী বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রেমী](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/9-2502061119.jpg)
ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে থেকে ফাদার মারিনো রিগন হয়ে উঠেছেন মনে-প্রাণে খাঁটি বাঙালি। এ দেশের সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে ভালোলাগা তা সত্যিই অনন্য। বিশেষ করে রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে দুর্বলতা তা মুগ্ধ করার মতো। অন্যদিকে লালনের গানের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ আকর্ষণ। অনেক সময় গির্জায় আলোচনাতেও রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করতেন। আবার কখনো কখনো লালনের বাণী ছিল তাঁর আলোচনার বিষয়। তিনি প্রায় বলতেনÑ ‘রবীন্দ্রনাথ আমার মগজে থাকেন, আর লালন বাস করেন আমার অন্তরে।’
ইতালি থেকে তিনি এদেশে যাজক হিসেবে এলেও জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন সাহিত্য চর্চার পেছনে। একই সঙ্গে তাঁর মানবিক কাজগুলোও তাকে অনন্য করে রেখেছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে ভালোবেসে তিনি যেমন হয়ে উঠেছেন খাঁটি বাঙালি। তেমনি বাংলাদেশও তাঁকে আপন করে নিয়েছে। স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। এ ছাড়া ২০১২ সালে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।
তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির পর্যটন শহর ভেনিসের নিকটবর্তী ভিল্লাভেরলা গ্রামে। এবারের ৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ। তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৫৩ সালে। প্রথমে তিনি সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাট জেলার মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর মিশনারি জীবন শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশনারিতে ছিলেন। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি থেকেছেন সুন্দরবনঘেঁষা শেলাবুনিয়া গ্রামে।
বাংলাদেশে বাংলাভাষা শিখতে গিয়ে তিনি বাংলাসাহিত্য পড়তে শুরু করেন। মূলত ভাষা শিখতে গিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রেমে পড়েন। এরপর নিজের ভালোলাগার কথা নিজ দেশের মানুষের কাছে জানাতে অনুবাদ শুরু করেন। একে একে তিনি ইতালিয় ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কবিবন্ধু জসীম উদ্দীনসহ আরও অনেকের কবিতা। শুধু রবীন্দ্রনাথেরই চল্লিশটি বই অনুবাদ করেছেন তিনি। পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন মরমি কবি ফকির লালন সাঁইয়ের বেশ কিছু গান। এ দেশের লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও তিনি নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ইতালি ভ্রমণ করেছেন। সেখানে তুলে ধরেছেন এদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এ দেশের নকশিকাঁথাকেও তিনি নিয়ে গেছেন বিশ^ দরবারে। এজন্য শেলাবুনিয়া গ্রামে গড়ে তুলেছেন সেলাই কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে নারীদের দিয়ে তিনি নকশিকাঁথা বুনিয়ে তা বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন ইতালির বাজারে। আর এখানকার নকশিকাঁথায় তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য। বাংলা সাহিত্য অনুবাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে নিজেও কয়েকটি মৌলিক বই লিখেছেন। এর মধ্যে শেলাবুনিয়ার রূপকথা উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি এ দেশের শিক্ষাসেবায়ও রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান। তাঁর উদ্যোগে মোংলা, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর কল্যাণমুখী নানা উদ্যোগ।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, আশ্রয়, খাদ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা তাঁর ডায়েরি, আলোকচিত্র ও অন্যান্য স্মৃতি স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তাঁর নামে মোংলার হলদিবুনিয়া গ্রামে মেলার আয়োজন করে রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া স্থানীয় সনাতনধর্মীদের পূজা-পার্বণেও অতিথি হিসেবে হাজির হয়েও রেখেছেন সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। টানা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে এদেশে থাকার পর ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে তিনি ইতালির ভিচেঞ্চায় প্রয়াত হন। তবে তাঁর ইচ্ছে ছিল এদেশের মাটিতেই শায়িত হবেন। সেজন্য মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর তাঁর মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং শেলাবুনিয়া গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়।