ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

ওয়াহিদুল হক ॥ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

অরবিন্দ মৃধা

প্রকাশিত: ১৭:০৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ওয়াহিদুল হক ॥ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

ওয়াহিদুল হক (জন্ম : ১৬ মার্চ, ১৯৩৩, মৃত্যু ২৭ জানুয়ারি ২০০৭), ৭৪ বছর বয়সের একজন যৌবনউদীপ্ত সংস্কৃতিকর্মীর নাম। বাঙালির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতির বার্তা, রবীন্দ্রচেতনা নতুন প্রজন্মের কানে তুলে দেওয়ার জন্য ওই প্রৌঢ় ওয়াহিদুল হকের মধ্যে যে উন্মাদনার জোয়ার দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু মনের অনুভব অনুভূতির সঙ্গে গেঁথে আছে থরে থরে।
দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কাঁধে স্বদেশী থলে ঝুলিয়ে চলেছেন অবিরাম গতিতে। যেন সব মানুষকে মানুষ হিসেবে, বাঙালি হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁকে কেউ দিয়েছেন। হ্যাঁ তাঁর আদর্শ রবীন্দ্রনাথ। চলনে বলনে, পোশাক-আশাকে, কর্মে, লিখনে, বচনে, কণ্ঠস্বর সাধনে ওয়াহিদুল হক একজন আপাদমস্তক বাঙালি।
   
বিরামহীন গতিতে কলাম লিখছেন,
সংগীত শিখাচ্ছেন, সভা সমিতি, মঞ্চে মাঠে, বক্তব্য করছেন,
সুষ্ঠুধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলছেন, শত অজানাকে জানিয়ে চেতনায় সুড়সুড়ি দিচ্ছেন, পথের ক্লান্তি ভুলে বিরামহীনভাবে দেশের আনাচ-কানাচ পর্যন্ত কর্মযজ্ঞে ছুটছেন। যেন মানুষ গড়ার সব দায়িত্ব তাঁর। বয়স আর শরীরের দিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না একবিন্দু। মাথা তাঁর মোটা ছিল, অশৈল্যে কিছু সহ্য করতে পারতেন না। যাকে দিয়ে যা করানো যায়, তাকে দিয়ে তাই করিয়ে নিতেন, আর বাকিটা নিজের বোঝা মনে করে মাথায় তুলে নিতেন! রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ নিয়ে দেশব্যাপী তাঁর কি অসাধারণ কর্মস্পন্দন! সাতক্ষীরা থেকে সিলেট বা পঞ্চগড় থেকে বান্দরবন সবখানেই তার আপনজন, সবখানেই গুটি গুটি পায়ে পদচারণ। ওই সময়ের রাজনৈতিক সংকট, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন; তাকে মানসিকভাবে খেপিয়ে তুলেছিল। ফলে ৭১-এর ন্যায় তার মসিতে প্রতিবাদ প্রতিরোধের বারুদ ছুটেছে। অবশেষে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ! আকস্মিকভাবে ২৭ জানুয়ারি ২০০৭ খ্রি. তিনি চিকিৎসকের সকল চেষ্টা, স্বজনদের প্রাণের আকুতি উপেক্ষা করে থেমে গেলেন! আমরা হারালাম একজন প্রকৃত মানুষ গড়া শিক্ষক, খাটি বাঙালি ওয়াহিদুল হককে।
তিনি রেখে গেছেন অজস্র কর্মী, ভক্ত অনুরাগী। আজ বিনম্র শ্রদ্ধায় মহাত্মা ওয়াহিদুলকে স্মরণ করি। তিনি অভয়দাতা, আঁধারের আলো। তিনি বাঙালি সংস্কৃতি চেতনার বাতিঘর। তাঁর শিকড় ছায়ানট। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিকদর্শন।
ওয়াহিদুল হক; একজন দুঃসাহসী বাঙালির নাম। তৎকালীন পাকজান্তা আইয়ুব খান সরকার বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে
বাংলার প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীগণ দেশজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করে। ১৯৬১ খ্রি. রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যৌবনউদীপ্ত প্রতিবাদী শিল্পী জুটি ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন শহরে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উৎসব পালন করেন।
‘রবীন্দ্রগীতির মুক্তি’ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন,’ সেনা শাসনের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, চ্যালেজ্ঞ করে ঢাকায় উদযাপিত হয় জয়ন্তী শতবার্ষিকী। এগারো দিন জুড়ে তিন’শ গান, চারটি নৃত্যনাট্য চারটি নাটক ও নানাবিধ প্রদর্শনীর সমন্বয়ে, সনজীদা ও আমি সে উপলক্ষে সম্ভবত এগারো শহরের অনুষ্ঠানে যোগ দেই’। ওই দ্রোহ থেকে জন্ম নেয় ছায়ানট। কবি বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর প্রথম সভাপতি। আর ওয়াহিদুল হক ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯৭১ সালে মুক্তি পাগল ওয়াহিদুল হকের প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংস্থা গড়ে ওঠে। তিনি ১৯৯৯ থেকে আমৃত্যুকাল পর্যন্ত ছিলেন ছায়ানটের সহ-সভাপতি। বহু শুভ কাজের নির্ভিক মাঝি ওয়াহিদুল হক। ছায়ানটের ছত্রছায়ায় দেশে বর্ষবরণ, পিঠা উৎসব, নবান্ন উৎসবসহ বাঙালি সংস্কৃতির নানা বিষয় জেগেছে। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, আনন্দধ্বনি, মুকুল ফৌজ, বাংলাদেশ ব্রতচারী সমিতি সহ-সুষ্ঠুধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন ওয়াহিদুল হকের হাত ধরে মুখরিত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্র নজরুলের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীসহ কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের জীবনকর্ম নিয়ে উৎসব, মেলা, পিঠা-পুলি পালাপার্বণ পালন, এবং ঈদ-পূজাসহ ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান বারো মাসে তেরো পার্বণের এই বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি এখন শহরকেন্দ্রিক জীবনেও নবজাগরণ সৃষ্টি করেছে। এগুলো বাঙালি সংস্কৃতির শিকড়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’। ১৯৬১ তে বাধা পেয়ে জেগে উঠে মুক্ত চিন্তার বাঙালি। স্বাধীনতার পথ সুগম হয় ওই একই পথ ধরে। ওয়াহিদুল হক সারাজীবন রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে ‘বাঙালির সম্পন্ন জীবনের ঠিকানা’ খুঁজেছেন। তার লেখনীতে ঘুরে ফিরে বারবার এসেছে বাঙালির কৃষি শিল্প বাণিজ্যে প্রাচীনত্বের কথা, শৌর্য-বীর্য, ইতিহাসের কথা, লোকজ সাহিত্য সংস্কৃতির কথা। এই অতুল সংস্কৃতিকে স্মরণে মননে টিকিয়ে রাখতে তার আজীবন সংগ্রাম। তিনি বলেছেন,’ অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমার মনে সংশয় দেখা দিয়েছে ওই সাংস্কৃতিক সম্পদের বাস্তবতা নিয়ে। বাংলাদেশে সমাজের কার্যকর অংশ সেই সাহিত্য সংগীতে লোককথায় ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক ভাণ্ডারকে বোঝা বলেই মনে করছে যেন এবং তা হিন্দু ভারতেরই প্রবিদ্ধ অংশ ভেবে বর্জন করতে প্রবৃত্ত হয়েছে। ‘(সূত্র : সংগীত সংস্কৃতি-১৪১০, পৃষ্ঠা-২৭)
ছাত্র অবস্থা থেকে প্রায় ৫৪ বছর ইংরেজি বাংলা কয়েকটি পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেছেন ওয়াহিদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন।
মূলত তিনি রবীন্দ্রপ্রেমী সংস্কৃতিকর্মী। তার প্রকাশিত গ্রন্থ; সংস্কৃতিই জাগরণের প্রথম সূর্য, চেতনা ধারায় এসো, গানের ভেতর দিয়ে, প্রবন্ধ সংগ্রহ অন্যতম। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ ও ভোরের কাগজে ‘অভয় বাজে হৃদয় মাঝে’ এবং ‘এখনও গেল না আঁধার’ শিরোনামে নিয়মিত দুটি কলাম লিখতেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের বার্ষিকী অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘সংগীত সংস্কৃতি’ তাঁর ছোঁয়ায় রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার এক ভুবন হয়ে উঠেছিল।
এই মহাপ্রাণ বাঙালি চেতনার বাতিঘর ওয়াহিদুল হককে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

×