![বইমেলার ইতিহাস বইমেলার ইতিহাস](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/6-2502061104.jpg)
বইমেলা মানেই জ্ঞানের মেলা, সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনস্থল। বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার স্থান নয়; এটি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। সময়ের বিবর্তনে বইমেলার ধারণা এবং গুরুত্ব অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। বইমেলার উৎপত্তি বেশ পুরনো। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ সংরক্ষণ এবং বিতরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় মানব সমাজে। প্রাচীনকালে গ্রন্থাগারই ছিল বই আদান-প্রদানের প্রধান কেন্দ্র। মধ্যযুগে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি বিনিময় হতো, কিন্তু ছাপাখানার আবিষ্কারের পর বই প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটে।
প্রথম দিকের বইমেলাগুলো ইউরোপে অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে প্রকাশকরা নতুন প্রকাশিত বই প্রদর্শন করতেন। ১৪৫০ সালে জার্মানির মেইনজ শহরে জোহানেস গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের পর বই ছাপানোর কাজ সহজ হয় এবং বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৬শ’ ও ১৭শ’ শতকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লিপজিগ শহরে বইমেলার প্রচলন দেখা যায়। ইউরোপ ছাড়াও চীনের প্রাচীন সভ্যতায় বই আদান-প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও মেলা বসত। মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত শহর বাগদাদ ও দামেস্কেও বিভিন্ন সময় বই বিক্রির জন্য বড় আকারের সমাবেশ হতো। পরবর্তীকালে, বইমেলার ধারণা ইউরোপ থেকে এশিয়া, আমেরিকা এবং অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলা ভাষায় বইমেলার সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে কলকাতায় হলেও, বাংলাদেশে বইমেলার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। ঊনবিংশ শতকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এবং অন্যান্য সাহিত্যকেন্দ্রিক এলাকায় বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা বই প্রদর্শনের উদ্যোগ নিত। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা ভাষার বই প্রকাশের সংখ্যা কম থাকলেও, ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং বই বিক্রির জন্য বিভিন্ন মেলার আয়োজন শুরু হয়। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা ঘটে ১৯৭২ সালে, যখন স্বাধীনতার পরপরই বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একদিনের বইমেলা আয়োজন করা হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলাকে নিয়মিত আয়োজনের উদ্যোগ নেয়, এবং ১৯৮৪ সাল থেকে এটাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এটি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে বইমেলা আরও বৃহৎ পরিসরে আয়োজন করা হতে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে বইমেলার প্রসার ঘটে এবং এতে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বইমেলা এবং এটি এক মাসব্যাপী চলে। এ মেলা শুধু বই কেনাবেচার জন্য নয়, এটি লেখক, প্রকাশক, পাঠক এবং সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বইমেলার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস রয়েছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা বিশ্বের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম বইমেলা, যা প্রথম শুরু হয় ১৪৫৪ সালে। এখানে বিভিন্ন ভাষার বই প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হয়। লন্ডন বইমেলা মূলত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ থাকে। নিউইয়র্ক বইমেলা প্রযুক্তিনির্ভর এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বইমেলা কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, যেখানে বাংলা ভাষার বইয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রকাশনাও স্থান পায়।
বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলার পরিধি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে বইমেলা শুধু প্রকাশকদের প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি লেখক, পাঠক, সাহিত্যিক ও গবেষকদের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। বইমেলার পরিধি প্রসারিত হয়েছে এবং এতে বৈচিত্র্য এসেছে। প্রথমদিকে বইমেলায় সাহিত্যকেন্দ্রিক বই প্রকাশিত হতো, তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যায়Ñ গবেষণা, ইতিহাস, আত্মজীবনী, শিশুতোষ, কমিকস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বইমেলা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হচ্ছে। বিদেশী প্রকাশকরা এখানে অংশ নিচ্ছেন এবং বাংলাদেশী প্রকাশকরাও আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশ নিচ্ছেন।
পরিশেষে বলা যায়, বইমেলা আমাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ইতিহাসের ধারক ও বাহক। এটি শুধু একটি বাণিজ্যিক স্থান নয়, এটি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, যা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের একত্রিত করে। ভবিষ্যতে আরও আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে বইমেলা তার গুরুত্ব ও আবেদন আরও বৃদ্ধি করবে। সরকার, লেখক, প্রকাশক, পাঠক সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বইমেলা তার ঐতিহ্য ধরে রাখবে বলে আশা রাখছি।