ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

একুশের বইমেলা বাঙালির বাতিঘর

সাইফুজ্জামান

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

একুশের বইমেলা বাঙালির বাতিঘর

সত্তর দশকে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারার কর্ণধর চিত্তরঞ্জন সাহা চাটাই বিছিয়ে সাধারণ একটা বইমেলা শুরু করেছিলেন তা এত বিস্তৃত হবে কেউ কি কল্পনায় ভেবেছে?
 ফেব্রুয়ারি মাস ক্যালেন্ডারের একটি নির্দিষ্ট মাস শুধু নয়Ñ এটি এখন বাঙালির আত্মমর্যাদা, প্রকাশের অহংকার ও নিজেকে উন্মোচনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে বইমেলা। প্রতিটি বাঙালি অপেক্ষা করে কখন আসবে ফেব্রুয়ারি, আর কখনই বা শুরু হবে বইমেলা। লেখক, পাঠক, প্রকাশক অধীর আগ্রহ অপেক্ষা এই প্রহরের। বাঙালির আবেগ আর ভালোবাসায় থরে থরে কম্পোমান বইমেলা। অজস্র বই প্রকাশিত হয়। কতটুকু মানসম্মত সব বই প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবু বই প্রকাশিত হয়। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বর্ণিল রঙের বিজয় নানা রঙে রঞ্জিত হয় বইমেলা। নতুন বইয়ের মাতোয়ারা গন্ধ ও বই স্পর্শ করার আনন্দে কেটে যায় বাঙালির দিনরাত্রি।
বইমেলা যখন শুরু হয়েছিল এর ব্যপ্তি এত ব্যাপক, কীভাবে সৃষ্টি হলো তা জানার আগ্রহ রয়েছে পাঠকের। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বইমেলার আলোচনায় সূত্রপাত ১৯৬১তে বাংলা একাডেমিতে। ১৯৬৪ সালে একটি বইমেলার আয়োজন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের নিচতলায়। প্রথমটি বছরের শুরুতে ও পরেরটা ১৮-২৪ অক্টোবর। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি সফল বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। সবচেয়ে সার্থক ও আশাসঞ্চারী বইমেলা ছিল ১৯৭২ সালের ২০-২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত বইমেলা। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। মুক্তধারা স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও বর্ণমিছিল বই বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক সরদার জয়েন উদ্দীনের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৭৩ ও ১৯৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দুটি বইমেলা ছিল নজরকাড়া।
১৯৭৪ সালের ১৪-২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছিল। সাহিত্য সম্মেলনে যুক্ত করা হয়েছিল বই প্রদর্শনী। একুশকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকে ছোট পরিসরের বইমেলার অস্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের সূচনা করেছিল তা পরে বৃহৎ পরিসরের বইমেলা আয়োজনের এক বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বইমেলায় আস্তে-ধীরে প্রকাশকদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে আয়োজিত বইমেলা পাঠক লেখকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাংলা একাডেমির প্রকাশনা, মুদ্রণ বিক্রয় বিভাগ ১৯৭৮ সালের ১৫-১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা আয়োজন করে। ১৯৭৯ সালে হয় আরেকটি বইমেলা। এসব মেলা প্রকৃত অর্থে প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যে ভরা ছিল। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার নামকরণ হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ক্রমে ক্রমে বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত বইমেলায় স্থান সংকুলানের অভাব তৈরি হয়। মূল প্রাঙ্গণের বাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলাকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
যন্ত্রসভ্যতার উন্নয়নের জোয়ারে বিশ্ব ভাসলেও বাঙালি তার শেকড় থেকে আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি। মাতৃভাষা বাংলা প্রীতি এক সুতোয় রেখেছে বাঙালিকে। আত্মপরিচয় শুধু দেশে নয় বিশ্বময় বিস্তৃত। বাংলা বইমেলা ফ্রাংকফ্রুট, লন্ডন-কলকতাজুড়ে হচ্ছে।
বইমেলা মানুষে মানুষে মৈত্রী গড়ে দেয়। সান্নিধ্য, আড্ডা, চর্চা, নিছক ভাব বিনিময় শুধু নয়, আড্ডা, খাওয়া, ছবি তোলা স্মৃতির অনুষঙ্গ। ঝরাপাতা, বিচিত্র ফুল, পাখির ডাক, নানা বয়সী পাঠকের কলরবে বইমেলা শুধু হয়ে ওঠে মিলনমেলা।
স্মৃতি ধূসরিত দিনযাপনের অনন্য কেন্দ্র একুশের বইমেলা। ভালোবাসার টানে, নতুন বইয়ের গন্ধে আমরা বইবেলায় আসি। আবার ঘরে ফিরে যাই।
মৌসুমি লেখকরা আসে বিদেশবিভূঁই থেকে। লেখক ও প্রকাশের মধ্যে পাণ্ডুলিপি ও অর্থ লেনদেন হয় এটা সবার জানা। দেশেও আছে এ ধরনের লেখক। প্রকাশক অর্থ হাতিয়ে নেয় মৌসুমি লেখকদের কাছ থেকে। প্রকাশনা সংস্থার কোনো সম্পাদনা বোর্ড নেই। শুধু হতাশার কথা নয়। আশাও আছে কিছু। সেই আশা আমাদের স্বপ্ন লালন করে। অনেক তরুণ লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিভাময় অনেক তরুণের লেখাপড়া মস্তিষ্ক ও মনন মনন দিয়ে অনেক পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়।
বইয়ের অধিক প্রকাশ, প্রচ্ছদের বর্ণিল রং সংস্কৃতিতে এক নবমাত্রা যুক্ত করে প্রতি বছর। মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় বিচিত্র ধারার সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ হয় সেক্ষেত্রে কারও দ্বিমত নেই। বিতর্ক, আড্ডা ও সৃষ্টির অগ্নিশিখার স্ফুরণ ঘটে বইমেলা জুড়ে। ছোট প্যাভিলিয়নের সাইজ (২০দ্ধ২০)। বই বিপণন যথাযথ স্বল্প পরিসরে করা কষ্টসাধ্য। জুলাই আন্দোলন/গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-কে নিয়ে গ্রাফিতি ও বই প্রকাশ বিস্তৃত। এগুলো স্মৃতি-বেদনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই বই ইতিহাসের স্মারক। এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ।’
বইমেলায় থাকছে ‘জুলাই চত্বর’ যা আকর্ষণীয়।
৭০৮টি প্রকাশনা সংস্থা স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। মূল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি প্রকাশনা সংস্থা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬০৯টি প্রকাশনা সংস্থার স্টলে প্রতিদিন আসছে নতুন বই। লেখা ও প্রচ্ছদ নান্দনিক।
৩৭টি প্যাভিলিয়নও চিত্ত আকর্ষক। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির রয়েছে ১টি প্যাভিলিয়ন। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বইমেলা উদ্বোধন করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখ করেন ‘জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছে। মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই অভ্যুত্থান এবারের বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে।’
বইমেলা শুধু বই বিক্রির জন্য নয়। এ মেলা মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মেট্রোরেল চলাচলের সুবিধার জন্য স্টলগুলোর বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রবেশপথ ও প্রস্থান গেটটি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪টি প্রবেশ ও ৪টি প্রস্থান পথ তৈরি করা হয়েছে।
নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে মাসব্যাপী বইমেলা প্রাণেরমেলায় পরিণত হয়েছে। জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
খাবার দোকান, ক্যাসেটের দোকান, রকমারি গৃহস্থালি সামগ্রী বেচাকেনা মেলায় যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল আশির দশকে, পরে এটা বিযুক্ত হয়ে প্রকৃত কেন্দ্রিক মেলায় পরিণত হয়েছে।
বইমেলায় রয়েছে আধুনিক প্যাভিলিয়ন, বহু রং ও রেখায় শোভিত বইমেলার স্টল প্রতিদিন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠছে। বিজ্ঞাপন ও ভাষায় রয়েছে ভিন্নতা ও চমক।
বইয়ের নামে এসেছে পরিবর্তন। প্রচ্ছদ সাইজ রয়েছে আকর্ষণ। সুসজ্জিত বইমেলায় প্রকৃতি নানা সাজে রঞ্জিত। ঝরাপাতা, বিচিত্র ফুল, পাখির ডাক ও নানা বয়সী পাঠকের কলরবে মুখরিত বইমেলা শুধু মিলনমেলা নয়, স্মৃতিভারে গ্রথিত একটি অনন্য কেন্দ্র। ভালোবাসার টানে, নতুন বইয়ের গন্ধে আমরা বইমেলায় আসি, আবার ঘরে ফিরে যাই। সঙ্গে নিয়ে যাই প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য স্মৃতি। বইয়ে পড়া কোনো চরিত্র অলক্ষ্যেই হয়ে যাই। আনন্দ-বেদনায় লীন হয়ে কখনো দুই চোখ ভিজে যায়। দীর্ঘশ্বাস বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসে। অতীতের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে যে দোলাচালে আমরা বন্দি থাকি তার সামান্যটুকুই আমরা ধারণ করতে পারি। বইমেলা ঘিরে আনন্দ ও শঙ্কা দুই-ই ভর করছে। শপিংমল, অফিস আদালত স্বাভাবিক নিয়মে চলছে বটে, তবু দুশ্চিন্তা পিছু পিছু হাটে। ইতোমধ্যে বিশিষ্ট কিছু সিনিয়র সিটিজেনকে হারিয়েছি কোভিড অতিমারির কারণে। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যান ধারণা এখন বদলে যাচ্ছে। ছেলে মেয়েরা জন্মের পর ট্যাব, অ্যান্ড্রয়েড ফোন ল্যাপটপ ব্যবহার করছে। ফাস্ট ফুডে আসক্ত হয়ে উঠছে। এখন হাতে নিয়ে বইপড়া, পত্রিকা দেখার চল ভাটার দিকে। নিজস্ব ঐতিহ্য অন্বেষা ও আপন আলোয় ফিরতে বই পাঠের বিকল্প নেই। বইমেলা ঘিরে রকমারি বইয়ের সমাহার দেখা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অনুভূতি আলাদা। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বইমেলা ঘিরে বইয়ের বিক্রি বেড়েছে। বইমেলায় নতুন লেখকদের অভিষেক ঘটে। ঢাকা শহরে বিনোদন কেন্দ্র সংকুচিত হয়ে গেছে। বইমেলায় আসা যাওয়ার কিছুটা বিনোদন ঘটে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ ক্ষণে বইমেলা আয়োজন করার আনন্দ উপভোগ করবে প্রকাশক, পাঠক ও লেখক। নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করে স্টল স্থাপন করার  বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। মেলায় আগত দর্শকদের যাতায়াতে শৃঙ্খলা রক্ষা দুরূহ ও অসম্ভব নয়। দুর্যোগ দূর্বিপাকে বাঙালি ঘুরে দাঁড়াতে জানে। কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নতুন স্থান নির্বাচন নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। বাংলা একাডেমির মূল ভবনের আশপাশে জায়গা কম। সঙ্গত কারণেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই হবে মেলা আয়োজনের মূল কেন্দ্র। মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক মানুষের ভাগ্য। বইমেলা আয়োজনে সতর্ক অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। শুভ হোক বইমেলা।
একুশের বইমেলা, প্রাণেরমেলা। এই মেলা ঘিরে প্রতিদিন জন্ম নিক নতুন অভিজ্ঞতা।

×