ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১

শিল্পী লিওনার্দোর চিন্তার বক্রতা

শতদল বড়ুয়া

প্রকাশিত: ১৮:৫৬, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

শিল্পী লিওনার্দোর চিন্তার বক্রতা

চিন্তার বক্রতা কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রকার কূপমণ্ডূকতাসম্পন্ন কূটবুদ্ধিপ্রসূত চিন্তা বা মানসিক অবস্থার কথা প্রতীয়মান হলেও কিন্তু গতি ও অন্যান্য অনেক কিছুর মতো স্থানে ও কালে চিন্তা ও বক্রগতি সম্পন্ন বা বক্রগতি লাভ করার ধারণার কথাই মূলত ঘোষণা করা হচ্ছে। চিন্তার বক্রতার কারণেই জ্যোতিবিজ্ঞানের যাত্রা পথিক কোপার্নিকাসই প্রথম ভেবে নিয়েছিলেন পৃথিবী গোল, গ্যালেলিও ভেবে বের করেছিলেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে না ঘুরে পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। চিন্তার বক্রতা কাজে লাগিয়েই কূটনৈতিক ও রাজনীতিকরা অনেক অসাধ্য সাধন করেন। গোয়েন্দারা ও চররা এই প্রক্রিয়াকে বেশি ব্যবহার করেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে তারা আবিষ্কার করে নিতে পারেন অনেক গোপন কথা। যেমন ধরে নেওয়া যেতে পারে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে কোনো ভাড়ার ঘোড়া পাওয়া যায় না। আপনি কখনো সমুদ্র সৈকতে যাননি। আপনার কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে বুদ্ধিমান একজন কথা প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় বলে গেল- সে একবার এখানে ভাড়া ঘোড়ায় চড়ার সময় পড়ে যায়। এই কারণে যে ঘোড়ায় ওঠার জন্য ঝুলন্ত কোনো লাগামের ব্যবস্থা ছিলো না। সে সঙ্গে সঙ্গে আপনার দিকে তাকিয়ে আপনাকে দৃষ্টি আকর্ষণ সহকারে সাক্ষীসূচক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো - কেমন, তাই না? এতে হ্যাঁ বা না সূচক জবাব ও তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেই সেই চালাক বন্ধুটি আপনার অজান্তেই জেনে নিলো আপনি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গিয়েছেন কিনা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জীবন দর্শনটা প্রণিধানযোগ্য। এ মহান শিল্পী ছিলেন ফ্রান্সের এক গণিকার সন্তান। তৎকালীন ফ্রান্সের জাতীয় দর্শন, সামগ্রিক জীবনবোধ ও সামাজিক চিন্তাধারা এবং পরিস্থিতির কারণে এ সমস্ত গণিকালয়গুলোর স্থানান্তর ও উচ্ছেদ সাধনের ফলে তার মাকে নিয়ে খুবই সংকটেই পড়েছিলেন। এই বিপাকে যেখানে নিজেদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা বা স্থায়িত্ব ছিলো না সেখানে এই পুত্র সন্তানকে নিয়ে কি করবে এবং তার নিরপরাধ শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার এক পরিচিত অবিবাহিত যুবক খদ্দের কাছে রেখে সেই গণিকালয় ত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্ত মতামতকে আর বিশেষ জোর দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা যা জানি, সেই এতিম বালক এসবের কিছুই জানতো না। তার পালক পিতা সেই অবিবাহিত চাকরিজীবী কর্মচারীটার বদলিতে তাকে রাখার সমস্যা হেতু একজন মুচির তত্ত্বাবধানে রেখে অন্যত্র চলে যান। মুচির সঙ্গে কাজ করতে করতে সে বেড়ে উঠতে লাগলো। অবসর সময়ে আড্ডা দিতো স্থানীয় বেকার যুবকদের সঙ্গে। এ শহরের কয়েকটি স্থানে যাতায়াতের সুবাদে পরিচয় হয় রকমারী পেশার ও বেকার যুবকদের সঙ্গে। তাদের কেউ ছিলো শিল্পপতির পুত্র, কেউ কেউ সংস্কৃতিমনা শিক্ষিত যুবক, ছাত্র ও বেকার। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ফলে আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র গড়ে ওঠে। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনো বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আর্ট কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো ক্লাব, একাডেমি, সভা-সমিতির হল বা মিলন কেন্দ্র।
আর্ট কলেজের নিয়মিত রুটিনমাফিক কার্যক্রম সমাপ্তির পর প্রায়ই শুরু হতো আড্ডা, সম্মেলন, সভা- সমিতির সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি। এভাবে নানা আচার অনুষ্ঠান ও তার আর্ট কলেজে পড়ুয়া বন্ধুদের সঙ্গে নিত্যদিনকার আড্ডা ও যোগাযোগের ফলে কিছু অঙ্কনমুখী চিন্তাধারার উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করতে থাকে কিশোর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভিতর।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এভাবে সে ২৪ বছর বয়সে সেই আর্ট কলেজে পড়ুয়া তার একজন বান্ধবীকে প্রেম নিবেদন করলে মেয়েটা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলে যে, মাতৃপিতৃ পরিচয়হীন ও ঠিকানাবিহীন কোনো ছেলেকে একজন অভিজাত কুলবংশের যুবতীর প্রেম ও পাণি গ্রহণ কোনোদিন কোনো সময় সম্ভব নয়। এই প্রত্যাখ্যানে লিওনার্দো মনে প্রচন্ড আঘাত পায়। হয়তো জীবনের প্রতি এভাবেই তার একটা বিকৃত মনোভাবের উদয় হলো।
পরবর্তী পর্যায়ে ভিঞ্চির বিবাহ বর্জনসহ ভবঘুরে জীবন ও চিন্তাধারা সবকিছুতেই তার ত্যাগের একটা চরমপন্থী মনোভাব প্রমাণ করে। কেননা ইচ্ছা করলে এই মহাপুরুষ এতো উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়েও বস্তুগত ও পার্থিব বা ন্যূনতম আর্থিক সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে যেতে পারতেন। এভাবে এক পর্যায়ে পালক পিতার প্রত্যাখ্যান, বন্ধুমহলের বিদ্রুপ ও উপেক্ষা, সমাজের মননহীন অবিবেচনা ও প্রতিভা বিকাশের বাধা বা অবমূল্যায়ন, প্রেম প্রত্যাখ্যান এসব মিলে তা ব্যথা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে এবং সে হয়ে পড়ে গভীর চিন্তাশীল। বারবার ভিঞ্চি তার প্রতিভা বিকাশের চেষ্টা করে। পূর্বেকার ফ্রান্সের সমাজের মানুষগুলোর সামগ্রিক মানসিক গঠন বা মননশীলতার স্তর আজকের মতো এমন উঁচুস্তরে ছিলো না যে তাকে গ্রহণ করবে, যে কিনা একজন পতিতার পুত্র। ঐ সময়কালীন একটা অবস্থা নিশ্চয়ই পেরিয়ে এসেছে সমাজ তার গতিশীলতার মধ্য দিয়ে। শিল্প জগতে তার বন্ধুরা তার সাহচর্য ও সহযোগিতার হাত ধরে তাকে খাটিয়ে নিতেও কার্পণ্য করতো না। যা হোক এটা ভালো ছিলো তার জন্যে। এভাবে তিনি সাহিত্য ও শিল্পজগতের সংস্পর্শে এসে একজন ক্ষুদে ব্যবসায়িক শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
এতে জীবিকা নির্বাহ হলেও তার পুরো প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। অল্প বয়েসী এ কিশোর সদা ভাবত ও অভিভূত হতো যে, তার লেখা বা চিত্র উচ্চমানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সমাজে তার কোনো সঠিক মূল্যায়ন হতো না বা প্রশংসা পেতো না। সে যাই হোক এভাবে তার শিল্পযাত্রায় বুৎপত্তি ও উচ্চ মার্গের অভিপ্রায় দেখে অনেকে নীরবে হাসতেন। তার বন্ধু-বান্ধীদের অধিকাংশই তাকে তার এই প্রয়াস দেখে ঠাট্টা বা ইয়ার্কি করতে সামান্যতম দ্বিধাগ্রস্ত হতো না। এতে করে মানুষ সম্পর্কে তার এক অদ্ভুত ও ভিন্নধর্মী ধারণা জন্ম নেওয়াই অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়।
যা হোক মানব চরিত্র, বিরূপ সমাজ বা জীবন এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত কারণে যে বদ্ধমূল ধারণা তার মনে জন্ম নিতে থাকুক না কেনো তিনি যে অতি উচ্চমানের মননশীল ব্যক্তি ছিলেন তা আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান। হতে পারে এটি সমাজের সামগ্রিক মননশীলতার পশ্চাদপদতা যার কারণে প্রচন্ড প্রতিভাবান ও ব্যক্তিত্বশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। এভাবে মনে হয় তার ঊনত্রিশ বছর বয়সের দিকে থাকিয়ে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন যে, তার জন্মসূত্রে কোনো দোষ রয়েছে। অর্থাৎ তিনি একজন গনিকার ছেলে বলেই তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিভার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এতো অন্তরায়। খুব সম্ভবত সেই সময়েই তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, তিনি পিতৃহীন নন, কারণ পিতৃহীন ছেলে জন্ম দিতে পারে না। তিনি মাতৃহীন নন, মাতাহীন শিশু জন্ম নিতে পারে না। তিনি পরিচয়হীন নন। যেভাবে হোক মাতৃপরিচয় বের করতে হবে। তিনি তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য নিবদ্ধ করেন তার মাতৃপরিচয় অন্বেষণে।
এই কাজটিই তখন তার জীবনের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মাতৃপরিচয় উদ্ধারে তিনি ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন চষে বেড়ান। জীবিকা নির্বাহের জন্যে পেশাজীবী শিল্পীর কাজও তাকে করতে হতো। এভাবে দেশান্তরিত শিল্পী জন্মস্থানের বন্ধুবান্ধবদের অবজ্ঞা ও তার সহজসরল স্বাতন্ত্র্যকে যেভাবে উপহাস করা হয়েছে সেই অভিমান ও গ্লানির কথা ভেবেই খুব সম্ভবত দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান নেন ও প্রবাস জীবনকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন হয়তো। যা হোক প্রচন্ড মানসিক চাপ, আত্মগ্লানি, অভিমান, ক্ষোভ, ব্যর্থতা ইত্যাদি মিলিয়ে যখন সে হারিয়ে যাচ্ছিলো অবক্ষয়ের অতলান্তে, এ সময় তার চিন্তায় খেলে গেলো বিদ্যুতের এক ঝলক। উদয় হলো নতুন এক বোধ। উন্মেষ হলো নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির। তখন তার বয়স হয়েছিলো পঁয়তাল্লিশ বছর। তিনি ভাবলেন যে, মাতৃহীন পরিচয়ের অভাবে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন, যার কারণে তার অবমূল্যায়ন হয়েছে। সেই একমাত্র মাতৃপরিচয় উদ্ধারের জন্যে মায়ের খোঁজে যদি তিনি গোটা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন তাহলে মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি ভাবলেন, তার মাকে খুঁজে পেতে পারেন একমাত্র তার অবয়বের মধ্যেই। তিনি নিজের বয়স হিসাব করে চিন্তা করলো তার মা যৌবনে যুবতী বয়সে যদি তাকে জন্ম দিয়ে থাকে তাহলে এতোদিন তিনি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই।
ভিঞ্চির এই বক্র চিন্তার কথা কেউ জানে না। ঘটনাটি দাঁড়ায় এরকম-ভিঞ্চি যা চিন্তা করে তা কেউ জানে না, আর ভিঞ্চি সম্পর্কে লোকে যা জানে তা ভিঞ্চি জানে না। যা হোক, তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে এসে তৈলচিত্র প্রদান যুবতীর প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন। পুরনো বন্ধুরা ভিঞ্চির মনে আবার নব যৌবনের উদ্রেক হয়েছে বলে কৌতুক করতেও ছাড়েনি। অনেকে কৌতূহলবশত তার প্রবাসের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন লিওনার্দোর আঁকা ছবিতে প্রতিকৃত মেয়েটি কে? কেউ মন্তব্য করলো নতুন প্রেমিকা, ভ্রষ্টা ইত্যাদি মিলিয়ে। অপবাদ ও অপমানের শেষ সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকলো। আর এই অপবাদের শেষ সীমা পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্র চেতনা ও ক্ষুরধার অনুভূতির পরিমাণও বেড়ে যেতে থাকে। (এই ব্যাপারটাকে ক্রিয়ার সম্প্রতিক্রিয়ার বিধিতে মেনে নেওয়া যায়)। এই তীব্র ভাবাবেগকে তিনি তার ক্ষেত্রে প্রকাশ করলেন। শিল্পীদের দৃষ্টি ভিন্ন। আমরা যা যেভাবে দেখি শিল্পীরা তা সেভাবে দেখে না। তারা দেখেন অন্যভাবে। তিনি তার যুবক বয়সের অবয়ব অনুকরণে মেয়েলী প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন। তার নিজের যৌবনের বাহু, ঘাড়, মাথা প্রভৃতি রমনীয় ঢং-এ আঁকতে শুরু করেন। অর্থাৎ তিনি মেয়ে হলে শারীরিক গঠন ও আকৃতি যেমন হতো শিল্পের প্রকরণের মাধ্যমেই তিনি সেভাবে তার শারীরিক কাঠামোর অনুকরণে তার মাতৃরূপটি ফুটিয়ে তোলেন। বাহু পুরুষদের না হয়ে মেয়েলী হলে নিশ্চয়ই শিরাবিহীন মাংশল হতো। গ্রীবা হতো ভরাট। চোখের কোটর হতো কটন, আংগুল হতো মাংশল, চুল হতো লম্বা। মুখমণ্ডল হতো দাড়ি বা গোঁফ বর্জিত। তার স্বল্প কুঞ্চিত কেশরাশি হতো ঢেউ খেলানো জলতরঙ্গ। এভাবে এক সুন্দরী তরুণীর ছবি আঁকতে গিয়ে শিল্পীকে নানা মানসিক নির্যাতন, কৌতুক, কৌতূহল, ঔৎসুক্য, বিদ্রƒপ ইত্যাদি কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে অবিরত। তবুও তিনি ছাড়েননি এ মত ও পথ।

×