ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

পাঠকের রুচি-নির্মাণ ও মননচর্চা

সায়মন স্বপন

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

পাঠকের রুচি-নির্মাণ ও মননচর্চা

আধুনিক কবিতায় অলংকার একটি প্রায়োগিক বিষয়। কবিতার শরীরে প্রয়োজন মতো অলংকার পরিয়ে দিলে আধুনিক কবিতা ভিন্ন মাত্রায় স্থান পায়। কিন্তু, এই অলংকারের ব্যবহার অত্যধিক হলে কবিতার মান চরম বিপর্যের মুখে থুবড়ে পড়ে। একজন সাধারণ নারীকে প্রয়োজন মাফিক অলংকারে সাজালে দেখতে সুন্দর, রুচিশীল ও মাধুর্যপূর্ণ মনে হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অলংকারে ঐ একই নারী সুন্দরের পরিবর্তে অরুচিশীল ও অসুন্দর মনে হতে পারে। ঠিক তেমনি করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অলংকারের ভারে কবিতার শরীরও ন্যুব্জ হয়ে পড়ে। কবিতার শরীর বিনির্মাণে কবিকে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। ঠিক কোথায় কোথায় কোন্ কোন্ অলংকার কিংবা রূপক-উপমা ব্যবহার করা দরকার তা কবিকে জ্ঞান রাখতে হয়। নইলে কবিতার শরীরে পচন ধরবেই। যে পচনের গন্ধে পাঠকপ্রিয়তা দূরে সরে যায়। পাঠকের মননশীল চর্চার খোরাক না হতে পারলে সেই কবিতার সার্থকতা নেই। পাঠক কবিতা পড়ে এবং চর্চা করে তার মনের খিদে মেটানোর জন্য। পাঠক তার প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে কবিতাকে সমান্তরাল রেখে নাগরিক-সমাজের চিত্র দেখতে চায়।

পাঠকের ভেতরের গল্প বলা:
পাঠক বরাবরই কবিতায় একটা গল্প খুঁজে ফেরেন। সে গল্পটা হতে পারে তার নিজের কিংবা অন্যের অথবা চলমান সমাজের। প্রশ্ন হলো- পাঠকের এই গল্পগুলোর খোরাক আধুনিক কবিগণ কতটুকু পূরণ করতে পারছেন? পাঠক তার মননশীল-চর্চায় সংশ্লিষ্ট আধুনিক কবিতাকে কতটুকু যুক্ত করতে পারছেন, সেটিও আধুনিক কবিগণকে মাথায় রাখতে হবে। কারণ, কবি কবিতা লেখেন পাঠকের জন্য। তাই কবিতায় পাঠকের ভেতরের গল্প বলতে পারাটা কবি ও কবিতার জন্য  সার্থক বলে মনে করি। কেননা, পাঠক এক এক শ্রেণির, এক এক মতবাদের। সুতরাং, কবিতাকে হতে হবে সকলের জন্য। ভিন্ন ভিন্ন পাঠক যখন কবিতা পড়বেন, তখন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে কবিতাকে তারা ভিন্ন ভিন্ন সামন্তরিকে আবিষ্কার করবেন। এটাই স্বাভাবিক। অথচ কবিতার শরীর একই থাকবে। এমন একটি কবিতা চরম সার্থকতার শিখরে পৌঁছে যায়। কবিতা যদি পাঠকের ভেতরে ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও আন্দোলিত করে, সেটিও মানোত্তীর্ণ কবিতা হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
জনমানুষের বোধগম্য কবিতা:
বর্তমানের আধুনিক কবিতার একটি ট্রেন্ড চালু আছে। সাধারণ মানুষ কবিতা বুঝুক বা না বুঝুক, কবিতাকে খুব কঠিন ও বোধগম্যহীন করে উপস্থাপন করা। কবিতায় কবি কি বোঝাতে চেয়েছেন, কবিও ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে অনেকটাই অপারগ। কারণ, কবি যে সব উপমা-রূপক তুলে ধরেছেন, তা একান্তই কবির মনগড়া। যা বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। ‘আধুনিক কবিতা সাধারণ মানুষ কম বোঝেন; মূলত বোদ্ধাদের জন্য আধুনিক কবিতা লেখা হয়’ এমনই ধারণা কথিত আধুনিক কবিগণ পোষণ করেন। সত্যিকার অর্থে ঐসব কবিতা সাধারণ মানুষ চেখে দেখে না। আধুনিক কবিতার নামে এসব কবিতা চালিয়ে দেওয়া, প্রকৃত অর্থে সাহিত্যের সঙ্গে প্রতারণা। পাঠককে ধোঁকা দেওয়া। পাঠক একজন কবির উপর ভরসা করে যে, কবি তার কবিতা দিয়ে পাঠককে সঙ্গ দিবে। অথচ, এই সঙ্গ দেওয়ার পরিবর্তে পাঠকের অধিকার নিয়ে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে। কেন আধুনিক কবিতা জনমানুষের কবিতা হবে না? কেন আধুনিক কবিতার নামে পাঠকের সঙ্গে এমন প্রতারণা করা হচ্ছে? এসব প্রশ্ন বর্তমানের আধুনিক কবিগণের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়াই যায়।

কবি, কবিতা ও পাঠকের মূল্যবোধ:
সভ্যতার শুরু হতে মানুষ তার জীবন ও জীবিকার শৈল্পিক রসায়ন অনুসন্ধান করে চলেছেন। খুঁজেও পেয়েছেন বৈকি। মূলত শিল্প ও সাহিত্যের মূল্যবোধের সঙ্গে জীবনযাত্রার যে মেলবন্ধন, তা বারংবার খুঁজে ফেরা হয়েছে। কবির মূল্যবোধের সঙ্গে কবিতার মূল্যবোধ সরলরৈখিক। পাশাপাশি এই সরলতার সঙ্গে পাঠকের মূল্যবোধকে সংযুক্ত করতে পারলে কবি, কবিতা ও পাঠককে একই সরলরেখায় দেখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কবিতায় রস ও বোধ সৃষ্টি করা কবির অন্যতম কাজ বটে। তবে, কবিতা যেন পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে তার জন্য কবিকে পাঠকের মূল্যবোধ মাথায় রেখে বেশ মেহনত করার প্রয়োজন। শিল্পের ভেতরের গল্পটা জটিল হলেও পাঠকের হাতে তা তুলে দিতে হবে একটি সাবলীল ছকে। কেননা, শিল্প আক্ষরিক অর্থে একটি মূল্যবোধ প্রকাশ করলেও পাঠকের মননচর্চায় তা তৃতীয়মাত্রায় আন্দোলিত হয়ে থাকে। এই আন্দোলিত অনুভূতিকে ধরতে পারাটাই আধুনিক কবিতার নৈর্ব্যক্তিক বিষয়। আধুনিক কবিতায় এই ধরনের অনুভূতি পাঠক খুঁজে না পেলে, পাঠক কখনই ঐ কবি ও কবিতাকে মনে রাখবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, একজন ক্রেতাকে জোর করে একটি পণ্য ক্রয় ও পণ্য ব্যবহারে বাধ্য করা যায় হয়তো। অথচ, একজন সুচিন্তিত পাঠককে জোর করে কবিতা ধরিয়ে দিতে পারলেও তা স্থায়ীভাবে দাগ ফেলে না। প্রসঙ্গত, কবিতাটি একটি রুচিশীল মূল্যবোধ সৃষ্টিতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে সেটিই মুখ্য হয়ে ওঠে। কবিতা পড়া আর কবিতা হজম করা এক কথা নয়। ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘কিছু বই খেতে হয়, অন্যগুলো গিলে ফেলা হয় এবং কিছু কিছু চিবিয়ে হজম করতে হয়।’ বেকনের এই কথা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, লেখার মূল্যবোধ বিস্তর পার্থক্য তৈরি করে মানসম্মত ও মানহীন দুটি বইয়ের মধ্যে। যার পার্থক্য কেবল পাঠকই নির্ধারণ করে থাকেন। একজন কবি সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে লিখেন। প্রতিটি কবিতায় একটি গল্প থাকে। এই গল্পগুলো প্রকৃতির কাছ থেকে ধার করা। প্রকৃতির এই গল্পগুলো এক একটি শিল্প। অথচ সমকালীন কিছু আধুনিক কবিতায় গল্পের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রকৃতির এই ধার করা শিল্প নিয়ে লেখক পাঠক তৈরি করেন, আর পাঠক লেখক তৈরি করেন। একে অন্যের পরিপূরক এবং সম্পূরক হিসেবে পরিগণিত। আধুনিক কবিতা থেকে পাঠক তার মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারেন এবং পাঠকের মননচর্চায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে, এমন আধুনিক কবিতা সমকালীন কবির হাত থেকে আশা করা একেবারেই অমূলক নয়।

×