আশির দশকের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কবি শামীম আহমদ। কবিতায় শামীম আহমদ স্যাররিয়ালিস্টিক, সিম্বলিস্ট এবং সঙ্গে সঙ্গে ফ্রয়েডীয় স্বপ্নবাস্তবতার বিশাল তারুণ্য নিয়ে ডানা মেলে উড়ে যেতে দেখেন নিজকে। তার ব্যবহৃত শক্তিশালী উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প, বীক্ষণের আধুনিকতা কাব্যপ্রেমীদের আগ্রহী করে তোলে। তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকার জন্য তিনি আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোতে অনেকটা অধরা থেকে গেছেন। তবু তার কবিতার বই যথাযথ বের হচ্ছে এবং তিনি পাশ্চাত্যের বর্তমান সাহিত্য ধারার সঙ্গে অনেক মনোযোগী হয়ে কবিতা লিখছেন। ইতোমধ্যে তার দশটি কাব্যসংহিতা বের হয়েছে। নতুন বর্ষের ফেব্রুয়ারিতে আরো একটি ‘কাব্যগ্রন্থ’ বের হওয়ার পথে।
তার সঙ্গে কথা বলেছেন- সাহিত্যিক আতাতুর্ক কামাল পাশা
যখন কবিতা লেখেন তখন কি কোনো ধ্যানের ভেতরে থাকেন?
কবিতা হলো এক ধরনের ধ্যান, এক পরম সাধনার ফসল, ঐশ্বরিকও বলা যায়, কারণ যখন একজন কবি কবিতা লিখেন সেই মুহূর্তে এই জাগতিক জীবনের বহু ঊর্ধ্বে তিনি বিচরণ করেন, ঠিক সেভাবেই আমি যখন কবিতা লিখি আমার চারপাশের সংবেদনশীল আত্মার চিৎকার আমাকে বাউল করে তোলে, মনে হয় যেনো ঈশ্বর আমাকে তাঁর মমতার চাদরে আচ্ছাদিত করে রাখেন, ঝর্ণার ধারার মতো কবিতা নাজেল হয় আমার মানসপটে। যদি যথাসময়ে লিখে রাখি তবে সেটা কবিতার রূপে উদ্ভাসিত হয়। আর না লিখলে সময়ের সুরঙ্গে হারিয়ে যায়।
কবিতা লিখতে হলে কবিকে যে অপ্রকৃতস্থ থাকতে হবে সেটা বড় কথা নয় বরং একজন কবিকে সময়কে ধারণ করে উৎকৃষ্ট শব্দের উন্নত ব্যবহার এবং মোহের তরঙ্গে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাওয়া-ই মন্ত্রসাধন।
আপনি যে সময় কবিতা লিখতে শুরু করেন, তখন সমসাময়িক জাতীয় পর্যায়ে কারা কবিতা লিখতেন?
আমার কবিতা লেখা শুরু সেই কৈশোর থেকে। যাঁদের কবিতা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে তার মধ্যে কবি নজরুল আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাতে সন্দেহ নেই, ডেভিড ফ্রস্ট এবং বোদলেয়ারও আমাকে খুব তাড়িত করে। কবি নাজিম হিকমত ছিলেন আমার প্রিয় কবি।
সবেমাত্র সেভেন বা এইটের ছাত্র, সম্ভবত ১৯৮১ সাল, সে সময়ের প্রধান কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়সহ সদ্য প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজ আরো অনেকে এবং আমাদের সিলেটের গণমানুষের কবি দিলওয়ারসহ আরো অনেকের কবিতা পড়তাম। তঁাঁদের অনেকেই আজ নেই। তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি আমার।
আপনার সময় আপনি কবিতা না লিখেও তো অন্য কোন ভালো কাজ করতে পারতেন? কেন কবিতা লেখার জগতে এলেন?
একটি জটিল প্রশ্ন করেছেন, কবিতায় কেনো আসা সেটা একটি ঘটনা আছে আপনাকে বলি, সালটা ১৯৮১, আমরা কিছু তরুণ মিলে একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছি মাত্র। সেই সংগঠনের থিম সং দরকার, আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো গানটি লেখার জন্য। আমি দীর্ঘ একরাত জেগে গান লিখলাম, অনুষ্ঠান হলো, গানটি মঞ্চস্থ হলো। পরে সিলেট রেডিও থেকেও প্রচার হলো। এই তো শুরু, আমাকে কে যেনো বিনি সুতার মায়াজালে বেঁধে নিলো।
এক ঘোর আচ্ছন্নতায় গ্রাস করে ফেললো। এই ঘোর থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তি মেলেনি আমার। ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করার সুযোগ এসেছে, রাজনীতি থেকে শিল্পপতি পর্যন্ত হওয়ার। কিন্তু আমি সবকিছু প্রত্যাখ্যান করেছি কবিতার জন্য। কিন্তু কবি হতে তো পারলাম না।
কবি হতে হলে নিজেকে এক অদৃশ্য আগুনে আত্মাহুতি দিতে হয়। আত্মঘাতী কবিতা কবিকে খেয়ে ফেলে যা আমার বেলায় এখনো হয়নি, আমি পারিনি এখনো।
আপনি কি মনে করেন, একটি কবিতা একটি যুদ্ধকে থামিয়ে দিতে পারে বা, যুদ্ধের মাঠে সৈনিকদের সত্য ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে? কবিতা লিখে আপনি মানুষের ও সমাজের কি উপকার করতে চান?
অবশ্যই পারে, কবিতা যেমন যুদ্ধকে থামিয়ে দিতে পারে, তেমনি যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকদের অনুপ্রাণিত করে বিজয়ের দ্বার পর্যন্ত নিয়ে যায়, যেমন করেছিলেন নজরুল তাঁর ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, তারপর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়ে একটি পরাধীন জাতিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে।
আমাদের ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্রান্তিকালে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র, তার কালজয়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিতে উদ্দীপ্ত করেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের রণাসংহন যুদ্ধ করতে সাহস যুগিয়েছিল।
১৮ শতকের ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রন বলেছেন কবিতা হলো নারীর মতো দুর্বোধ্য এবং ফুলের মতো সুন্দর, আগুনের মতো দাহ্য ক্ষমতা নিয়ে ভস্মীভূত করে সকল অপশক্তিকে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা আবর্জনা থেকে মুক্তি এনে দেয় এবং একমাত্র কবিতাই পারে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়তে দিকনির্দেশনা দিতে।
আপনি আপনার চিত্তের আনন্দের জন্য কবিতা লেখেন, না কি মানুষের জন্য কবিতা লেখেন?
চিত্তের আনন্দ তো বটেই তারপর সমাজ ও রাষ্ট্রের এক প্রকার দায়বোধও কাজ করে। কবিতা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যদি নিজেকে আনন্দ দেয় তখন সেই কবিতা আর নিজের থাকে না তখন সে কবিতাটি সার্বজনীন হয়ে যায়, যে কবির কবিতা সার্বজনীন হয়েছে সেটাই কাল উত্তরণের পথে যাত্রা করে, একজন ভাবুক থেকে একজন কবির রূপান্তর, সেই দিক থেকে চিন্তা করলে আসলে সমাজ দেশ এবং তথা আমার চারপাশের দৃশ্য অদৃশ্য সবকিছু নিয়েই চিন্তার বিস্তার আমার কবিতার রাজ্যপাঠ।
আজকের দিনে একজন কবির সামাজিক দায়বোধ কি?
সমাজের প্রতি একজন কবির দায়বদ্ধতা অপরিসীম, কবি গোষ্ঠী সমাজ গঠনের গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, চারদিকে যখন ঘোর অন্ধকার নেমে আসে তখনই জ্বলে ওঠে কবির কলম, আগুনের দূত তারা, মুক্তির সোপান, অসুর সংহারে কবিতা একটি বল্লম। তাই আজকের এই দিনে দেশ যখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এই মুহূর্তে একজন কবিই পারেন দেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থে একটি আলোর পথ দেখাতে।
আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ এবং আমার সকল কাব্যপ্রেমীদেরও অজস্র ধন্যবাদ।