প্লিজ, ওপেন দ্য ডোর... কলিংবেলটা অনবরত বাজছে, ওয়াশরুম থেকেই শুনতে পায় বিপাশা। অফিস থেকে আজ ঘণ্টাখানেক আগে ফিরেছে সে। কুলসুমা সেই সকালেই তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় গেছে। বিপাশা অফিস থেকে বেরোনোর আগেই বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়েছে আজ। এখন আষাঢ়ের মাঝামাঝি। এ সময় ঢাকা শহরে ঘণ্টাখানেক বৃষ্টি হলে রাস্তা চলাচলে কেয়ামত নেমে আসে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সে উচ্চৈঃস্বরে বলে, জেরিন, শুনতে পাচ্ছ না কলিংবেল বাজছে! আশ্চর্য! মোবাইল হাতে নিলেই কোন দুনিয়ায় চলে যাও তুমি? যাও, দেখ কে এসেছে। জেরিন তখনো মায়ের মোবাইলে মশগুল। মায়ের কথা কানে এলেও মোবাইল টিপতে টিপতে বলে, মা, কে আর আসবে, ম্যাম এসেছে হয়তো, এখন তো ম্যাম আসার সময়। বলতে বলতেই মোবাইলটা বিছানায় রেখে প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খোলে। ম্যাম! গুড আফটারনুুন। ম্যাম প্রত্যুত্তরে কী বলে সেটা জেরিনের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না আর। ম্যাম প্রতিদিনই বিরক্ত হয় জেরিনের ওপর। কী এক বিরক্তিকর বেল বেজে যায় প্রতিদিন, প্লিজ, ওপেন দ্য ডোর! দুয়েকবারের বেলে জেরিনের দরজা খোলার কোনো রেকর্ডই নেই। জেরিন গিয়ে পড়তে বসে। ক্লাস টেস্ট শুরু হয়েছে তার। শুরু হয়েছে নয়, আজকাল প্রায় সারা বছরই স্কুলগুলোতে ক্লাস টেস্ট লেগেই থাকে। সে ঢাকার এক স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনার চেয়ে তার বেশি ঝোঁক নানা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের দিকে। টুকিটাকি কয়েকটা কাজ সেরে চুলোয় চা বসায় বিপাশা। বেসরকারি এক সংস্থায় মাঝারি গোছের কর্মকর্তা বিপাশা, বর আহসান উন্নয়নকর্মী। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় উচ্চ পদে কর্মরত আহসান সম্প্রতি কক্সবাজারে পোস্টিং হয়ে সেখানেই থাকছে। প্রতি সপ্তাহে এসে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয় সে। আজ তার আসার কথা। কুলসুমা সেই সকালে গেছে, পৌঁছেছে কি না তা জানায়নি। বিপাশাও সময় পায়নি খোঁজ নেওয়ার। মোবাইলটা নিয়ে কুলসুমার নম্বরে ফোন করে বিপাশা। ফোনটা অনেকক্ষণ বাজার পর রিসিভ করে কুলসুমা। জানায় দুপুরেই পৌঁছে গেছে সে। বিপাশা বলে, শোনো, দেরি করো না, তিনদিন পরেই চলে এসো কিন্তু। জি আপা। আর তোমার জন্ম নিবন্ধন আর চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটও আনবে এবার। জি আপা। ভুলে গেছি, মনে নাই, এসব অজুহাত দেওয়া চলবে না কিন্তু, মনে রেখ। জি আপা। ফোনটা রেখে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে ওভেনে ঢুকায় বিপাশা। কুলসুমার কথা ভাবে। বছর দুই আগে বিয়ে হয়েছিল কুলসুমার। স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে সে ঢাকায় আসে গার্মেন্টসে চাকরির উদ্দেশ্যে, পরে সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি তার। বিপাশার বাসায় কাজ নিয়েছে মাস দেড়েক হলো। দেখে আঠারো-উনিশের বেশি হয় না তাকে। কুলসুমা সম্ভবত বয়স নিয়ে মিথ্যা বলেছে। জেরিনের ম্যামকে টিফিন আর চা দিয়ে দুয়েকটা কথা বলেই নিজের রুমে আসে বিপাশা। ক্লান্ত লাগে। শুয়ে পড়ে অগত্যা। মোবাইল হাতে নেয় ফেসবুকে চোখ বুলাবে বলে। হঠাৎ মিনিমাইজ করা একটা ফাইল চোখে পড়ে। সম্ভবত চ্যাট জিপিটি। ইংরেজিতে দীর্ঘ কথোপকথন। পড়তে শুরু করে বিপাশা। হ্যালো, কেমন আছ? হ্যালো, ভালো। তুমি কেমন আছ? আমিও ভালো আছি। আমি তোমাকে আমার কিছু কথা বলতে চাই, তুমি কি শুনবে? অবশ্যই। আমি তো তোমাকে সাহায্য করতে চাই, তুমি বল তোমার কথা। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার ক্লাসের দু’জন সহপাঠী আমাকে খুব পছন্দ করে। তাদের মধ্যে থেকে সাবিব আমাকে প্রপ্রোজ করেছে। আমাকে বলেছে, সে আমাকে ভালোবাসে! আমি তো শুনে অবাক হয়ে গেছি। এতে কঠিন এবং বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমন অনেক কিছু ঘটতে পারে যদি তোমার করণীয় বিষয়ে জানা না থাকে। এ ব্যাপারে তোমার অনুভূতি কী, এবং তুমি কী করতে চাও? আমি তাকে না করে গিয়েছি। মনে হচ্ছে তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ! সে কীভাবে এটা গ্রহণ করেছে? তোমার এখন কেমন অনুভব হচ্ছে? আমি সত্যিই জানি না সে কী ভাবছে। আমি তাকে বলেছি, আমরা এখনো অনেক ছোট। আর আমরা তো বন্ধু। এখন এসব করার বয়স নয়। মনে হচ্ছে তুমি বিচক্ষণতা ও মানবিকতার সঙ্গে পরিস্থিতিটা মোকাবিলা করেছ। তুমি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তোমার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছ এবং বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দিয়েছ। এখন তুমি কেমন বোধ করছ? আমার মনে হয়েছে সে বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। আমি কি ঠিক করেছি? হ্যাঁ, মনে হয় তুমি সঠিক কাজটিই করেছ। তুমি সততা এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে বন্ধুত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছ এবং এত অল্প বয়সে নিজের ভবিষ্যৎ গঠনের দিকে জোর দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুনে ভালো লাগছে যে, সে বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। তোমার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। তোমাকেও শুভেচ্ছা। তোমার যদি আর কোনো প্রশ্ন থাকে এবং সহায়তার প্রয়োজন হয় আমাকে নির্দ্বিধায় জানাবে। লেখাগুলো পড়া শেষে বিপাশা একটু থমকে যায়, ভাবে। জেরিনকে এখন কিছুই বলা যাবে না। লেখাগুলো এভাবেই থাক। ম্যাম আসাতে জেরিন লেখাগুলো ডিলিট করতে ভুলে গেছে। পরে নিজেই ডিলিট করে দেবে। সে যে বিষয়টা জেনেছে সেটা আপাতত জেরিনকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত ঠিক করে নেয় বিপাশা। বাইরে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে আবার। ইউটিউবে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান শুনতে শুনতে কিচেনে ঢুকে নিজের জন্য চা বসায়। হঠাৎ ম্যাঁও ম্যাঁও শব্দে সচকিত হতেই কিটিকে চোখে পড়ে, কিচেনের সামনে ঘুরঘুর করছে বেচারা, তাকে মনেই ছিল না এতক্ষণ। বিপাশা কিটির ভাষা বোঝে না। কিটির সাথে সখ্য বেশি আহসানের। সপ্তাহ শেষে সে যখন ঢাকা আসে কিটি তার পিছে পিছে ঘোরে, যতক্ষণ বাসায় থাকে কিটি তার সঙ্গেই লেগে থাকে আঠার মতো। জেরিন আর কুলসুমার সঙ্গেও ভালো খাতির কিটির। বিপাশার সঙ্গে কিটির সম্পর্ক ভালো হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। বিপাশা যতক্ষণ বাসায় থাকে এটা-সেটা নিয়ে সবাইকে বকাঝকায়ই ব্যস্ত থাকে। কিটিকে আলাদা করে সময় দেওয়াটা আর হয় না তার। কড়া এক কাপ চা বানায় বিপাশা। মোবাইলে গান বন্ধ করে চা-টা নিয়ে পুবের বারান্দায় গিয়ে বসে। কিটি চলে যায় জেরিনের রুমে। একটু উঁকি দিয়ে জেরিনকে দেখেও নেয় বিপাশা। পড়ায় মশগুল। বাতাস না থাকাতে বৃষ্টিতে বারান্দা ভেজেনি। চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয় বিপাশা। বৃৃষ্টির শব্দটা তার কান থেকে দূরে বহুদূরে সরে যায়, মৌনী করে তোলে তাকে।
॥ দুই ॥
সাতাশ বছর আগে মফস্বল শহরের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরী প্রথমবারের মতো প্রেম বলে কিছু অনুভব করেছিল তখন। সেই সময়ে, সেই বয়সে তৈরি হওয়া এক গভীরতম বোধ, সারল্য, আজও স্মৃতিতে অম্লান, আজও একান্ত নিভৃতে দোলা দিয়ে যায় মনের বনে। কিশোরীর সেদিনের সেই অনুভূতিতে এক কিশোর হয়ে উঠেছিল তার একান্ত আপনার কেউ, হয়ে উঠেছিল কাক্সিক্ষত পুরুষ। একই কলোনিতে থাকত তারা। কিশোর এসএসসি পাস করে একাদশ শ্রেণিতে তখন। কিশোরী একদিন রাইটিং প্যাডে বড় বড় অক্ষরে চিঠি লিখল তাকে। প্রথম প্রেমের চিঠি। চিঠিটা যখন সে লিখেছিল তখনো তার জানা ছিল না এটাই তার লেখা শেষ চিঠিও। আর কোনোদিন তাকে লিখতে হবে না কোনো চিঠি। চিঠিটা যখন কিশোর পায় তখন বিষয়টা দুই পরিবারের বাইরেও এলাকার অনেকেই জেনে যায়। কিশোর অকপটে বলে, আমি তো তোকে ছোটবোনের মতো দেখি। তোর আমাকে নিয়ে এমন ভাবা ঠিক হয়নি! কিশোরী সেদিন বলতে পারেনি, আমি তো তোমাকে নিয়ে কেবল ভাবিনি, আমি তোমাকে অনুভবও করেছি এবং কখনো কখনো সেটা একান্ত অনুভব! সেদিনের সেই কিশোরী আজ বয়সের তুলনায় প্রৌঢ়; কিন্তু এখনো সেই কিশোরী মনটাকে সঙ্গে নিয়েই পাড়ি দিচ্ছে সে জীবনের বন্ধুর পথ। আর কখনো কাউকে সে বলতে পারেনি, ভালোবাসি। বৃষ্টি কমে এসেছে, কিন্তু বিপাশার চোখের কোণে যুগ-যুগান্তরের জমে থাকা অশ্রুবিন্দু একটু একটু করে গড়িয়ে পড়ে। স্মৃতির সমুদ্রে নিজেকে আরেকবার ভিজিয়ে সে ফিরে আসে কংক্রিটের জীবনে। চোখ মুছে চায়ের কাপে হাত দিয়ে দেখে, ঠান্ডা। কাপে চুমুক দিতেই ভুলে গেছে সে। বৃষ্টি কমে এসেছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে। হঠাৎ গলার কাছটায় কী একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠতে চায়। চা-টা নিয়ে ফিরে আসে কিচেনে। চুলা জ্বালিয়ে গরম করতে দেয়। তার ভাবনায় আবার ভর করে জেরিন আর চ্যাট জিপিটির কথোপকথন। আগামী সপ্তায় কয়েকদিন ছুটি আছে। সে আর জেরিন কক্সবাজার যাবে আহসানের কাছে। তখনই না হয় জেরিনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা যাবে। মানুষে মানুষে যখন পারস্পরিক কথোপকথন কমে আসবে তখন কোথায় যাবে মানুষ! যন্ত্রের কাছে! না, তা কখনো হওয়ার নয়। যন্ত্রের সঙ্গে বসবাস বাস্তবতা হলেও তা মঙ্গলকর নয়। আগামী পৃথিবীর নতুন এক সংগ্রাম হল মানুষে মানুষে নির্ভার কথোপকথনের অঙ্গীকারে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। পড়ার ঘর থেকে জেরিনের কন্ঠ শোনা যায়, আম্মু, চুলায় কী বসিয়েছ? পোড়া গন্ধ আসছে! জেরিনের কথা বিপাশার কানে পৌঁছায় না। সে তলিয়ে যেতে থাকে ভাবনার চোরাবালিতে।