প্রচণ্ড শীতে আর একটুও শুয়ে থাকতে পারল না বেচারা কালু মিয়া। ‘আম্বিয়া তুই কই’! কথাটা বলেই ঠক ঠক লাঠির শব্দে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। বয়স নব্বই। পরনে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি। হাফহাতা গেঞ্জিটার এক হাতা আছে আর এক হাতা নেই। আর পাবেই বা কোথায়? কিনে দেওয়ার মতো কোনো মানুষও যে নেই...। একটা ছেলে যাও ছিলো, চার বছর আগে করোনায় নিয়ে গেলো।
যাহোক এবার হুকুর হুকুর কাঁশতে কাঁশতে কোনো রকম লাঠি ভর দিয়ে বেরিয়ে এলো তার সহধর্মিণী আম্বিয়া বেগম। বুড়ীর চুল পেকেছে, বয়স হয়েছে, চোখে ছানিও পড়েছে; তবুও স্বামীর জন্য ভালোবাসা একটুও শুকিয়ে যায়নি। তাইতো হাতের আন্দাজেই কোমরের গোজ থেকে দিয়াশলাই বের করে কতকগুলো শুকনোপাতা জালাল। শীত থেকে বুড়োটাকে বাঁচাবার জন্য।
এ সমাজের মানুষেরা কালু মিয়ার একটা সুন্দর নাম থাকলেও কালু বুড়ো আর তার সহধর্মিণীকে কালু বুড়োর বউ বলেই সম্বোধন করে। কত স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ইতো এদেশের মানুষকে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিল। তবুও এই স্বভাবটা মানুষের পরিবর্তন হলো না। অবশ্য এসব নিয়ে কালু মিয়ার অভিযোগ কোনকালেই ছিল না, আর অস্ত বেলায়তো অসহায়ত্বের কাছে পরাজয় বরণ করেই নিয়েছে। তাই এসবের প্রতি মোটেই কোনো তোয়াক্কা নেই। তবে একটা বাসনা আছে মনের ভিতরে, সেটা শুধুমাত্র একটি ‘কালো কম্বলের।’
এদিকে টপটপ করে চালের ছাউনির উপর থেকে কুয়াশা চুইয়ে পড়ছে কালু মিয়ার মাথায়। কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। যখন এক ফোঁটা আম্বিয়া বেগমের মাথায় পড়লো, তখনই তাড়াহুড়ো করে ছেঁড়া গামছাটা এনে স্বামীর মাথায় পেঁচিয়ে দিল। এটাকেই বলে বুঝি ভালোবাসার মুদ্রা নিক্ষেপণে জয়লাভ। ঘরে ছাউনি নেই, পেটে ভাত নেই, শীতের পোশাক নেই, তবুও মায়ামমতার দরিদ্রতা নেই।
অনেকক্ষন চুপ থাকার পর আম্বিয়া বেগম এবার আস্তে করে বললো, ‘রাগ না করলে আমনেরে একখান কথা কইতাম।’
‘কী কথা ক’। সায় দিতেই স্বামীকে বলল, ‘কালকা হুনলাম মীরবাড়িতে কম্বল দিব।’
‘কী কইলি তুই! আমারে মানুষের কাছে আবারও অপমান করবার চাস।’
‘আহা! রাগ করেন কিয়ের লাইগা। মনে নাই, গতবছর কম্বল না পায়া ফেরত আওনের সময়, মীর সাহেব না কইছিল, পরের বার বেকতের আগে আমনেরে কম্বল দিব। হেইর লাইগা কইছিলাম যান। এইবার বলে মেলা কম্বল আনছে। আর আমনেরেতো একটা কালো কম্বলের লাইগা অনেক দিনের শক।’
এবার সন্ধ্যা তারার মতো ঝিমিয়ে পড়লেন কালু মিয়া। ঐ একটা জায়গাতেই তার অনেক দিনের দুর্বলতা। কিন্তু শখের কাছে পরাজয় বরণ করে অপমানের স্বাদ পেতে তার একটুও ভালো লাগে না। কারণ, এ সমাজ তেল ওয়ালার মাথায় তেল দেয়, আবার অপ্রয়োজনীয় পাত্রে বিলিয়ে দিতেও অনেকটাই পছন্দ করে। গতবছর মীরবাড়ি হতে খালি হাতে ফেরার সময় কেঁদেছিলেন যতটা না কম্বলের জন্য, তার চেয়ে বেশি লজ্জার বিষ ফোঁড়া বুকে বিধার জন্য।
অনেকক্ষণ পর আবার আম্বিয়া বেগম করুণ সুরে বললেন, ‘যান আর ইতস্তত কইরেন না। এইবার আমনেরে ঠিকই দিব।” অবশেষে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও যাওয়ার জন্য রাজি হলেন কালু মিয়া।
আজ একবারের জন্যও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। তবে দেখা যাচ্ছে মীরবাড়ির সামনে হাজার দুয়েক লোকের আনাগোনা। মাইকে চিৎকার করে লাইন ধরানো চলছে। আর এক এক করে মীর সাহেবের সঙ্গে কম্বল নিয়ে পড়েছে সেলফি তোলার ধুম। বেশ কিছু কালো কম্বল হাতে করে মানুুষ বাড়ির পথ ধরেছে। কিন্তু, কালু মিয়া দেখলেন এরা যারা কম্বল পেয়েছেন তারা সকলেই মোটামুটি স্বাবলম্বী। কিন্তু যারা অসহায় তারাতো এখনও পেলেন না। তারপরও লাইনে দাঁড়িয়েই রইলেন কালু মিয়া।
হঠাৎ কানে শব্দ ভেসে এলো, ‘আজ আর কম্বল বিতরণ হবে না।’ কিন্তু কালু মিয়া দেখলেন কম্বলতো এখনও বেশ কিছু আছে! তাইতো কালু মিয়া লাঠি ভর করে সামনে গিয়ে বললেন, ‘কম্বলতো আছে, আমারে একটা দেইন না সাহেব।’ মীর সাহেব বললেন, ‘এগুলা আমার লোকের লাইগা। আগামীবার আইসো তোমারে একখান দিমুনে।’
‘কী কন মীর সাহেব! গতবারওতো একই কথা কইছিলেন।’
কোনো পাত্তা না দিয়ে মীর সাহেব বললেন,‘এই শোন, তোরা কালু বুড়ার লাইগা সামনের বার একটা কালো কম্বল রাখিস। যাও কথা বাড়াইয়ো না দেহি বহুত কাম আছে আমার।’ একথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে রইলো কালু মিয়া। এবারও অবশেষে খালি হাতে বাড়ির পথ ধরলেন। আর লজ্জায় সেই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ির পথ ধরলেন। এখন তার কানে ভাসছে আম্বিয়ার কথা, আর চোখে কালো কম্বলের ছবি।’
কালু বুড়োর কম্বল
শীর্ষ সংবাদ: