জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বংলাদেশের আত্মপ্রকাশ মাত্র বায়ান্ন বছর আগে হলেও এই ভূখণ্ডে বাঙালি জাতির বসবাস কিংবা কাল যাপনের সময়টা বেশ পুরনো। প্রাকৃতজন থেকে একুশ শতকের বাঙালি, এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে গিয়ে তার সংস্কৃতি, বোধ-বিশ্বাস আর মানস লোকে অতি স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্য করা গেছে বিবিধ পরিবর্তনের ছাপ। গ্রহণ আর বর্জনের দোলাচলে কালে কালে সে তার স্বরূপের একটি শক্ত ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তার ভাষা, কাব্য, লোকসাহিত্য, নীতি-ধর্মবোধ, শ্রেণিচেতনা সর্বোপরি স্বাধীন আকাক্সক্ষা। বাংলা ভাষার উদ্ভব বিষয়ে ড. আহমদ শরীফের মতে ‘জাতি পরিচয়ে বাংলা ভাষা ইন্দো-য়ূরোপীয় আর্যভাষার প্রাচ্য শাখার অন্তর্গত। প্রকৃতির কোলে লালিত প্রাকৃত জনের তথা লোক-সাধারণের মৌখিক বিকৃতিজাত বলে কথ্যরূপের নাম প্রাকৃত। বাংলাও আঠারো শতক অবধি প্রাকৃত ভাষা বা শুধু ভাষা নামে অভিহিত হতো। ঋগে¦দীয় ভাষার কথ্যরূপ থেকে মুখে মুখে কালিক বিবর্তনের ফলে আজকের লিখিত বাংলার ও বিভিন্ন অঞ্চলের বর্তমান বুলির উদ্ভব।’ চর্যাপদে বাঙালি শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলি’, তবে পন্ডিতেরা কেউ কেউ এই ‘বঙ্গালী’ শব্দটির ভিন্ন অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। চুরাশিজন সহজিয়া বৌদ্ধাচার্যের মধ্যে মীননাথ, কানুপা লুইপা, বিরূপা, ধামপা প্রভৃতি কয়েকজন বাঙালি ছিলেন। নাথযোগী সিদ্ধাচার্য মীননাথ বা মৎসন্দ্রনাথ নিজে চন্দ্রদ্বীপ তথা বরিশালের অধিবাসী বাঙালি এবং কৈবর্ত ছিলেন বলে মনে করা হয়ে থাকে। আর্য পিতৃগণের প্রাচীন গ্রন্থে পূর্বজনপদবাসী গৌড়-বঙ্গ-সুহ্ম সমতটের সন্মন্ধে সশ্রদ্ধ উল্লেখ নেই। প্রাচীন যুগে বাঙালির অনেক খ্যাতির পাশাপাশি অখ্যাতির কথা গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। সেগুলোতে এক ধরনের অবজ্ঞাসূচক ভাব ছড়িয়ে আছে। জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরকে নগ্নভাবে পথ চলতে দেখে কুকুর লেলিয়ে দেওয়াসহ বাঙালিদের অনেক অভব্য আচরণের কথা প্রাচীন জৈনগ্রন্থে পাওয়া যায়। বাঙালি সম্পর্কে সবচেয়ে কঠোর উক্তি করেছিলেন উনিশ শতকের ইংরেজ শাসক ও ইতিহাসবিদ টমাস মেকলে। তিনি লিখেছিলেন : ‘মেষের যেমন শিং, বাঘের যেমন থাবা, ভ্রমরের যেমন হুল, প্রাচীন গ্রিক গান-অনুযায়ী স্ত্রীলোকের যেমন সৌন্দর্য, তেমনই বাঙালির হল প্রতারণা।’ উনিশ শতকের শুরুতেই বাঙালিদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একটি নব্য বাবু সমাজ গড়ে ওঠে। যাদের মধ্যে একাংশ ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত; তাদের আজ্ঞাবহ কেরানীকুল, দারোগা, তহশীলদার, মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি। আর একদল ছিলেন গত শতকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপকারভোগী আয়েসী জমিদারশ্রেণী। সম্ভবত তাদের লক্ষ্য করেই বঙ্কিমচন্দ্র জানতে চেয়েছিলেন ‘গোরু হইতে বাঙালি কিসে অপকৃষ্ট?’ তিনি লিখেছিলেন ‘বিধাতা শৃগাল হইতে শঠতা, কুকুর হইতে তোষামোদ ও ভিক্ষানুরাগ, মেঘ হইতে ভীরুতা, বানর হইতে অনুকরণ পটুতা এবং গর্দ্দভ হইতে গর্জন-এই সকল একত্র করিয়া নব্য বাঙালিকে সমাজ-আকাশে উদিত করিয়াছেন।’ তবে বঙ্কিমচন্দ্র মেকলের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন এভাবে যে, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির চরিত্র সমালোচনা কথাটা কতকটা যদি সত্য বোধ হয়, তবে বলা যাইতে পারে বাঙালির এখন এ দুর্দশা হইবার অনেক কারণ আছে। মানুষকে মারিয়া ফেলিয়া তাহাকে মরা বলিলে মিথ্যা কথা বলা হয় না। কিন্তু যে বলে যে বাঙালির চিরকাল এই চরিত্র,বাঙালি চিরকাল দুর্বল, চিরকাল ভীরু, স্ত্রী-স্বভাব, তাহার মাথায় বজ্রাঘাত হোক- তাহার কথা মিথ্যা। ’বাদশাহ্ বাবুরের আত্মচরিত ‘বাবুরনামা’য় তিনি বাঙালি মানসের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় দিয়েছেন- ‘বাঙালিরা ‘পদ’কেই শ্রদ্ধা করে। তারা বলে আমরা তখতের প্রতি বিশ্বস্ত। যিনি সিংহাসন অধিকার করেন আমরা তারই আনুগত্য স্বীকার করি।’ তাই হয়তো কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন ‘রাজভক্তি সরলতা বাঙালির ধন।’ পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ পাঠাগার থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেছিলেন। এতে তিনি প্রমাণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্ব আর অতীত গৌরব। কিন্তু বাঙালিকে নিয়ে তিনিও যে মন্তব্য করেছিলেন তা বাঙালি চরিত্রের নেতিবাচক দিকটিকেই তুলে ধরেছিল।‘ তৈল’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন ‘বাঙালির বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালির একমাত্র ভরসা তৈল-বাঙালির যে কেহ কিছু করিয়াছেন ,সকলই তৈলের জোরে, বাঙালিদের তৈলের মূল্য অধিক নয় ; এবং কি কৌশলে সেই তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হয়, তাহাও অতি অল্পলোক জানেন। যাঁহারা জানেন, তাহাদিগকে আমরা ধন্যবাদ দিই। তাঁহারাই আমাদের দেশের বড় লোক, তাঁহারাই আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া আছেন’। বাঙালি জাতির এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলির আংশিক সত্যতা থাকতেও পারে। তবে তা যে সকল ক্ষেত্রেই বা সবার পক্ষেই প্রযোজ্য তা মানতে পারা যায় না। বাঙালির সাধারণ চরিত্র বিচার করতে বসলে তার ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। সেইসঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে তার জাতিসত্তার উৎস ও বিবর্তন। পলিবাহিত উর্বর এই ভূখণ্ডে অনেক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের প্রচার-প্রসার, নানান জাতিসত্তার মানুষের ভাগ্যান্বেষণে আগমন, বসতি স্থাপন, বিবাহ-সন্তানজন্ম, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বিপুল প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ জন্ম দিয়েছে একটি মিশ্র অথচ সহনশীল সংস্কৃতি। এর দ্বান্দ্বিক প্রভাবেই গড়ে উঠেছে বাঙালির সমাজ। পন্ডিতজনেরা এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। ড. আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখছেন ‘বাঙালি সঙ্কর জাতি। নানা গোত্রের রক্তের মিশ্রণের ফলে বিভিন্ন চারিত্রিক উপাদানের বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছে তাদের জীবনে। এর ফলে বাঙালি চরিত্রে নানা বিরুদ্ধ গুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। ভাবপ্রবণতা ও তীক্ষবুদ্ধি, ভোগলিপ্সা ও বৈরাগ্য, কর্মকণ্ঠা ও উচ্চাভিলাষ, ভীরুতা ও অদম্যতা, স্বার্থপরতা ও আদর্শবাদ, বন্ধনভীরুতা ও কাঙালপনা প্রভৃতি দ্বান্দ্বিকগুণ বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী রাধাকমল মুখার্জ্জী (১৮৮৯-১৯৬৮) তাঁর ‘বিশাল বাঙ্গালা’ গ্রন্থে লিখছেন ‘বাঙালির এই রক্তমিশ্রণ তাহার প্রধান গৌরব। ইহা হইতেই আসিয়াছে বাঙালির কোমলতা ও ঔদার্য। তাহা ছাড়া বাঙলার মাটির, বাঙালার জলের, প্রতিবেশের প্রভাব খুব প্রত্যক্ষ, খুব নিবিড়। বাঙালি তাই সবক্ষেত্রে ভাবুক উদার ও সেরা বিদ্রোহী। তাই আর্য্য সংস্কৃতি ও বেদ বিরোধী বৌদ্ধধর্ম বাঙলাতে প্রথম ও প্রধান আশ্রয় পাইয়াছিল।’
বাঙালির যাপিত জীবনে ভাবপ্রবণ বৈশিষ্ট্য তার শিল্প-সাহিত্য-কলা ও যাপিত জীবনে বিশেষভাবে প্রকট হয়ে আছে। এ বিষয়ে পণ্ডিতপ্রবর দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখছেন ‘আশ্চর্য্যরে বিষয় এই ভাব-প্রবণতা -যাহা বাঙালি জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যাত্ম-সম্পদের অধিকারী করিয়াছে-তাহা নীরস ও শুষ্ক জড়বাদীরা নিন্দা করিয়া থাকেন। যুগে যুগে আদর্শ ভিন্ন হয়; এক যুগে যাহা সর্ব্বজন প্রশংসিত, অন্য যুগে তাহার গুণাগুণ-সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠে, এমন কি তাহা নিন্দিত হয়। সুতরাং আদর্শের বিচার নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু যে যুগেই বাঙালি যে আদর্শের পশ্চাৎ ধাবিত হইয়াছে, সে তাহার পিছনে এতদূর চলিতে পারিয়াছে যে তাহা অপর জাতির বিস্ময়ের বস্তু হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’ আরেকজন বিশিষ্ট লেখক এস, ওয়াজেদ আলী বাঙালি সম্পর্কে বিশেষ গৌরবকথা লিখে গেছেন। তাঁর মতে বিভিন্ন জাতির শত শত বৎসরের সংমিশ্রণের ফলে উদ্ভূত বাঙালি জাতির কতকগুলি সুনির্দ্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে। যথা : বাঙালি শান্তিপ্রিয়, যুদ্ধবিগ্রহ, মারামারি, কাটাকাটি সে ভালোবাসে না। বাঙালি বুদ্ধিমান, ভাবপ্রবণ, সঙ্গীত, সাহিত্য, কলাবিদ্যা প্রভৃতিকে অন্তরের সঙ্গে সে ভালোবাসে।’ তিনি ভবিষ্যতের বাঙালিকে বিশ্বচেতনা গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রধান ও বিশ্বস্ত সমর্থক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই নিজস্ব জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠতে খুব বেশি একটা সময় লাগেনি। ঔপনিবেশিক শাসনামলে দেশপ্রেমে আর আত্মত্যাগে বাঙালি এগিয়ে ছিলো আর সবার চেয়ে অনেকটা সামনে। নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) তাঁর ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন ‘আজ বাঙালি জীবনের যে জিনিসটা প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ সেটা এই, মৃত্যুযন্ত্রণারও অনুভূতি নাই। আছে হয় পাষাণ হইয়া মুখ বুজিয়া সহ্য করা, অথবা সঙ্গাহীন হইয়া প্রাণমাত্র রাখা; আরেকটা ব্যাপারও আছে, জাতির মৃত্যুশয্যায় চারদিকে ধনগর্বে উল্লসিত বাঙালি প্রেত ও প্রেতিনীর নৃত্য’। নিরোদ সি চৌধুরী আরও লিখেছিলেন ‘ব্যক্তিবিশেষের পুনর্জন্ম হয়, তাহা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু জাতির বেলায় হইতেও পারে। বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম অতীতে দুইবার হইয়াছে।- ভবিষ্যতে আরও একবার হইতে পারে।- যদিও বা হয়, পুনর্জন্ম আমি দেখিব না। কিন্তু আমার দেখা-না-দেখার কোনো অর্থ আছে কি? কাল নিরবধি। আমার জীবনের সঙ্গেই বাঙালির জাতীয় জীবন শেষ হইয়া যাইবে না। বাঙালির ইতিহাস থাকিবে, বাঙালি আবার যদি উন্নত নাও হয়, তাহা হইলেও তাহার সৃষ্ট যে কীর্তি তাহার ঐতিহাসিক সার্থকতা থাকিবে।’ বাঙালির এই পুনর্জন্ম সম্ভব হয়েছিল উনিশশত একাত্তরে। সেবার বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল তার হাজার বছরের বঞ্চনা, অবিরাম লুণ্ঠন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। সৃষ্টি করেছিলো মহত্ত্বম কীর্তি, বাঙালির নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র- সার্বভৌম মানচিত্র। আমরা অভীষ্ঠ লক্ষ্যাভিমুখে চলেছি কিনা এ বিচার সময়ের হাতেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। নির্মোহ বিচারে বলা যায় আমাদের অর্জন আর বিচ্যুতি সবই আমাদের স্বভাবজাত। বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না’ তাই আমাদের সব মহৎ সূচনাগুলোর পরিসমাপ্তিও সুখকর হয় না। আবেগ তাড়িত সিদ্ধান্ত বারবার আমাদের ভয়ংকরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আবার পরিণামে আশাভঙ্গের বেদনা তেমনই দ্রুত আমাদের পেয়ে বসে।
পন্ডিতজন যেমন বলেছেন ‘কাল নিরবধি’ ‘বাঙালির ইতিহাস থাকিবে’ তাই সব অন্ধকার কে দূরে ঠেলে; আমাদের মানস চেতনার ঔদার্য দিয়ে ইতিহাস নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করে, আমরা এই ভূখণ্ডের বাঙালি একদিন নিশ্চয়ই বিশ্বমানবে পরিণত হতে সক্ষম হব।
উৎস থেকে...
শীর্ষ সংবাদ: