ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১

বনের রাজার যুদ্ধ

বিচিত্র কুমার

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

বনের  রাজার যুদ্ধ

একটা ছিল বিস্তীর্ণ বন, যেখানে বহু প্রাণী বাস করত। সেই বনের একক শাসক ছিল রাজা সিংহ। তার গর্জন শুনলেই বনের সমস্ত প্রাণী ভয় পেয়ে যেত। রাজা সিংহের বিশাল দেহ, শক্তিশালী দাঁত এবং গায়ের লোমের মধ্যে একটি অবিস্মরণীয় আভা ছিল। তার মতো শক্তিশালী আর কোনো প্রাণী ছিল না বনে। সিংহের শাসন এতটাই কঠোর ছিল যে, বনের অন্য প্রাণীরা কোনো ভাবেই তার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পেত না। কিন্তু তার রাজত্বে এক ছোট্ট শেয়াল ছিল, যার নাম ছিল কুটিল।
কুটিল ছিল অত্যন্ত চতুর এবং বুদ্ধিমান। সে তার প্রতিটা কাজ খুব পরিকল্পনা করে করত এবং কখনোই সরাসরি শক্তির মোকাবিলা করত না। একদিন রাজা সিংহ কুটিলকে দেখে ভেবেছিল, ‘এই ছোট্ট শেয়াল যদি আমার শাসন মেনে না চলে, তবে তাকে শিক্ষা দেওয়া উচিত।’ সিংহ একটি পরিকল্পনা করল, যাতে কুটিলকে তার শাসনের অধীনে আনতে পারে।
সিংহ একদিন কুটিলের কাছে গেল এবং বলল, ‘শেয়াল, তোমার চতুরতা আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি যদি আমার রাজত্বের অধীনে কাজ না করো, তবে তোমার জন্য বিপদ হতে পারে।’ কুটিল জানত, সিংহের রাগের সামনে কেউ টিকতে পারে না। তবে সে সিংহের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভয় পায়নি। বরং সে নিজের চতুর মননকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিল।
কুটিল বলল, ‘রাজা সিংহ, আমি আপনার শাসন মেনে চলতে প্রস্তুত। তবে আমি একটি শর্তে কাজ করব। আপনি যদি আমার শর্ত মেনে চলেন, তবে আমি আপনাকে কিছু এমন একটি উপকারি কাজ দেব, যা আপনার রাজত্ব আরও শক্তিশালী করবে।’ সিংহ আগ্রহী হয়ে বলল, ‘তুমি কী বলছো, শেয়াল? কী কাজ তোমার আছে?’
কুটিল চুপ করে একটু ভাবল এবং বলল, ‘রাজা সিংহ, আপনার রাজ্য খুব বড়। কিন্তু আপনার কিছুটা বুদ্ধির অভাব রয়েছে। যদি আপনি আমাকে আপনার পরামর্শক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং আপনার অহঙ্কার কমান, তবে আমি আপনাকে এমন একটি উপহার দিতে পারি, যা আপনাকে আরও শক্তিশালী করবে। তবে, যদি আমি ব্যর্থ হই, তবে আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন।’
সিংহ হাসল এবং বলল, ‘তুমি খুবই চতুর, শেয়াল। আমি তোমার শর্ত মেনে নিলাম। তবে মনে রেখো, তুমি যদি আমার শাসন অস্বীকার করো, তবে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।’ কুটিল তখন রাজা সিংহকে একটি পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেল। পাহাড়টি ছিল খুবই উঁচু এবং সেখানে একটি সোনালী রত্ন ছিল। সিংহ বিশ্বাস করত, রত্নটি তার শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। কুটিল সিংহকে বলল, ‘রাজা সিংহ, এই পাহাড়ের চূড়ায় আপনি যদি পৌঁছতে পারেন, তবে সেই সোনালী রত্ন আপনার শক্তি বৃদ্ধি করবে। তবে পাহাড়ের পথ খুবই কঠিন।’
সিংহ তার অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য উঠতে শুরু করল। কুটিল তার পেছনে পেছনে চলছিল, যেন তাকে প্ররোচিত করছে। সিংহ যতই চূড়ায় উঠতে থাকল, ততই তার শক্তি আরও বাড়তে লাগল। কিন্তু সিংহ জানত না যে, কুটিল তার জন্য একটি ফাঁদ পেতেছে।
পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর সময় সিংহ একটি ভয়াবহ পাথরের ঢালুতে পা ফেলল। তার ভারী দেহের কারণে পাথর ধসতে শুরু করল এবং সিংহ একেবারে নিচে পড়ে গেল। সিংহের গা এলিয়ে পড়ে গেল, তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। কুটিল নিচে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘রাজা, এই হলো সেই অহঙ্কারের ফল। আপনি নিজের শক্তিতে বিশ্বাস করলেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে, বুদ্ধি ছাড়া কোনো শক্তিই স্থায়ী হয় না।’ রাজা সিংহ অবাক হয়ে কুটিলের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল, কেবল শক্তি দিয়েই কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, বুদ্ধি এবং নীতিও প্রয়োজন। কুটিল তাকে বুঝিয়ে দিল যে, শুধু বাহুবল দিয়ে কোনো রাজত্ব টিকিয়ে রাখা যায় না। বরং বুদ্ধি এবং ন্যায়বিচারও গুরুত্বপূর্ণ। রাজা সিংহ শঙ্কিত হয়ে বলল, ‘শেয়াল, তুমি সঠিক বলেছো। আমি অহঙ্কার এবং গর্বের কারণে অনেক ভুল করেছি। আমি এখন বুঝতে পারছি, শক্তির সঙ্গে বুদ্ধির মিশ্রণই আসল ক্ষমতা। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।’
কুটিল হাসিমুখে বলল, ‘রাজা, আপনি যদি নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং পরিবর্তন গ্রহণ করেন, তবে আপনার রাজত্ব অবশ্যই শক্তিশালী হবে।’ এভাবেই সিংহ তার অহঙ্কার ত্যাগ করল এবং বনের অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে সম্মানের সাথে শাসন চালানোর প্রতিজ্ঞা করল। কুটিল এবং সিংহের মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধুত্বের সূচনা হল। সিংহ বুঝতে পারল, কেবল বাহুবল নয়, বুদ্ধি এবং নম্রতা ছাড়া রাজত্ব সফল হওয়া সম্ভব নয়।

×