বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের নানাবিধ অ্যানাউন্সমেন্ট কানে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে চেকিং করে বোর্ডিং পাস সেরে খুব টিপটপ ফুড লাউঞ্জে বসে কফিতে চুমুক দিতেই সামনের টেবিলে চোখ গেল রোহনের। খুব সুন্দরী এক নারী মনোযোগ সহকারে মোবাইলে কিছু একটা করছে। নারীটিকে কেমন চেনা চেনা লাগছে পিউ না তো? না না এ হতেই পারে না। এ কত স্মার্ট সুন্দরী কত আকর্ষণীয় আর পিউ একটা আনকালচার্ড গেওভূত ছিল। কিভাবে সুতি শাড়ি পরে লম্বা চুলে খোঁপা করে রাখতো, অবশ্য গায়ের রংটা খুব ফর্সা ছিল। আর মহিলার তো ঘাড় থেকে সামান্য নিচে কালার করা সিল্কি চুল, টপ জিন্স পরা, না না এ পিউ হতে যাবে কোন দুঃখে? মনের ভুল চোখের বিভ্রম বলে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবারও চোখ যায় ওদিকে। সুন্দরী মহিলাটি খাবার আনতে সামনে আগায়। রোমেনও উঠে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল কি স্নিগ্ধসুবাস আসছে তার শরীর থেকে। খুবই দামি পারফিউম বোঝাই যাচ্ছে। মহিলাটি একটু একটু করে প্লেটে সব আইটেম তুলে নিচ্ছে। যদিও ব্রেকফাস্ট তবুও অনেক আইটেম, পোলাও, ভুনা খিচুড়ি, চিকেন, মাটন, বিফ, মহিলা ওসবের ধারে কাছেও গেল না। খুবই অল্প কিছু সসেজ, কিছু জয়তুন, এক পিস পাউরুটি, মাখন, আর এক গ্লাস পাইনঅ্যাপেল জুস নিল। রোহনের খাওয়া আগেই শেষ হয়েছে। সে কফি দিয়ে শেষ করতে চেয়েছিল কিন্তু একটা প্লেট নিয়ে আবারও কিছু নেওয়ার ছলে মহিলাটির পাশে পাশে হাঁটছে। হঠাৎ করেই মহিলাটি রোহনের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে রোহন তুমি?
চমকে উঠে রোহন বলে হ্যাঁ আমি । তুমি পিউ না?
কেন আমাকে পিউ বলে মনে হচ্ছে না?
আসলে অনেকদিন পর দেখা তো তাই বুঝতে পারছিলাম না,চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। পিউ বলে, চলো টেবিলে বসি। একই টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল।
রোহন প্রথম জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছ?
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, ওখানে আমার শ্বশুরশাশুড়ি ননদ দেবর ভাসুর থাকে। আমার শ্বশুর অসুস্থ। পাঁচ দিন আগে আমার ছেলে মেয়ে ওদের বাবার সঙ্গে চলে গিয়েছে। আমি এদিকটা গুছিয়ে তবে আজ যাচ্ছি। রোহন মনে মনে ভাবে ঘরের কাজ গুছিয়ে যেতে পাঁচ দিন পরে যেতে হলো? ও সেই নিষ্ককর্মাই রয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল কি গোছালে তুমি?
পিউ বলে আমাদের ফ্যাক্টরির এমপ্লয়ীদের সেলারি দিলাম, একটা সিপমেন্ট ছিল ওটা কমপ্লিট করলাম। সামনের মাসের জন্য শিপমেন্টের কাজ ওদের বুঝিয়ে দিয়ে গেলাম। তাছাড়াও জারিফের আরও ব্যবসা আছে সেগুলোরও কিছু কিছু দেখতে হয়েছে। ও হঠাৎ করে সংবাদ পেয়ে চলে গেছে তাই ওর অনুপস্থিতে আমাকে সব করতে হলো। রোহন মাথা ঘুরে পড়বে না আছাড় খেয়ে মরবে ভেবে পাচ্ছে না। যাকে সে অকর্মা ভেবে অপমান করেছে, কত খারাপ কথা বলেছে যাকে তার কোন দিক দিয়েই ভালো লাগেনি আজ তার এরূপ অবস্থান দেখে সে সত্যিই মর্মাহত। হাত দিয়ে নিজের গায় চিমটি কাটে সব সত্যি শুনছি নাকি স্বপ্ন দেখছি? না সবই দিনের আলোর মতো সত্যি।
পিউ জিজ্ঞেস করে তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আমিও অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছি আমার অফিসের কাজে অফিস থেকেই পাঠাচ্ছে।
ও ও তুমি কি আগের অফিসেই আছো?
হ্যাঁ শুধু একটু প্রমোশন হয়েছে।
শুনেছিলাম জেরিনের সঙ্গে তোমার বিয়েটা টিকেনি?
ঠিকই শুনেছ দুই বছর টিকে ছিল একটি মেয়ে হওয়ার পর ওর অফিসের কলিগের সঙ্গে চলে যায়। মেয়েটাকে দেখাশোনার জন্য লালন পালনের জন্য আরেকটি বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু ও আমার মেয়েটিকে এত অপছন্দ করতো যে রূপকথার সৎ মায়েদেরও হার মানায়। এ নিয়ে প্রবলেম হওয়ায় ও চলে যায়।
পিউ মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে এখন কি চার নম্বরটা আছে? রোমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে চার নম্বর আর হয়নি মেয়েটাকে এক হোস্টেলে রেখেছি। তুমি যাওয়ার পর থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার জীবনের সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
না না রোহন, তুমি এখনো মিথ্যে কথা ছাড়তে পারলে না। আমি যাওয়ার পর তো তুমি জেরিনকে নিয়ে স্বপ্নের দেশে উড়ে বেরিয়েছ। জেরিনের সঙ্গে যখন তোমার সম্পর্ক চলছিল তখনকার দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো আমার বুক ভেঙে কান্না আসে। তুমি কখনো আমার কষ্ট বুঝতে চাওনি বরং জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কষ্টটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। স্ত্রী হিসেবে তো তুমি আমাকে পেয়ে খুব সেটিসফাইড ছিলে। তোমার জীবনের প্রথম নারী ছিলাম আমি। তুমিও প্রথম পুরুষ ছিলে আমার, অথচ যখন জেরিনের দিকে তোমার মন প্রাণ চোখ সব গেল, তোমার কাছে আমি হয়ে উঠলাম তোমার জীবনের বড় শত্রু বড় বিরক্তকর মানুষ। অফিস থেকে সাজুগুজু পরিপাটি সেন্ট মাখা জেরিন দেখে বাসায় এসে সুতি শাড়ি পরা গায়ে সংসারের হলুদ মরিচের ঘ্রাণ যুক্ত আট পৌরে নারী খুব বেমানান লাগতো তোমার। আমাকে তো কোনোদিন ভালোই বাসোনি শুধু প্রয়োজন মিটিয়েছো। করেছ নিষ্ঠুর তাচ্ছিল্য, প্রয়োজন মিটে গেছে ছুড়ে ফেলে জেরিন তুলে নিলে। তুমি ছিলে নির্মম আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর একজন মানুষ। তোমার অল্প বেতনের সংসারে কত কষ্টে দিন কেটেছে, তবু কোনো চাহিদা ছিল না আমার। তোমার সংসারে না ছিল প্রাচুর্য না ছিল স্বাচ্ছন্দ্য তবুও ছাড়তে চাইনি। মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলাম। অথচ তুমি আমায় ছেড়ে দিলে। জেরিনের নেশায় অকারণে নিন্দা কুচ্ছা রটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছ আমায়। চূড়ান্ত অবহেলায় দুর্দান্ত অপমানে অন্তহীন যন্ত্রণায় কেটেছে নিদারুণ প্রহর। যখন প্রমোশন হলো কত স্বপ্ন দেখেছিলাম সংসার গোছাবো মনের মতো করে। আমার নিজের একটা সংসার হবে সন্তান হবে, স্বামীকে নিয়ে সন্তান-সংসার নিয়ে আঁকড়ে থাকবো। অথচ সাফল্য পেয়ে কাছের মানুষটা হয়ে গিয়েছিল দূরের মানুষ আর তোমার দূরের মানুষই হয়ে উঠেছিল কাছের মানুষ। সময় মতো মানুষ বুঝতে পারে কে কাছের কে দূরের। ততদিনে কাছের মানুষটাও সত্যিসত্যি দূরের মানুষ হয়ে যায়। সুসময় দুধের মাছির অভাব হয় না।
রোহন বলে জীবনের সবকিছু কি আমার ভুল ছিল তোমার কি কোনো ভুল ছিল না?
না আমার তো কোনো ভুল ছিল না বলে নিজেকে বিন্যস্ত করে পিউ।
রোহন বলে আমি না হয় না বুঝে সরে গিয়েছিলাম তুমি কেন জোর করে আমায় ধরে রাখোনি?
এখন তোমার এরকমই মনে হবে আমি আমার প্রাণের উত্তাপ ভালোবাসা আকুতি দিয়েও তোমায় ফিরাতে পারিনি বুঝাতে পারিনি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। জেরিনের তো একটা জব ছিল তুমি না থাকলেও চলতে পারতো কিন্তু আমার কথা কি তুমি একটিবারের জন্যও ভাবতে পারোনি আমার কি হবে কোথায় যাব? আমার তো কোন জব ছিল না। তুমি জেরিনকে নিয়ে যখন সুন্দর সুখময় সময় কাটিয়েছো তখন আমি বাবার বাড়িতে একাকীত্ব নিঃসঙ্গ রাত জেগে দারুণ কষ্টে নির্ঘুম রাত করেছি পার। তুমি জানো না আমি আসার সময় তোমার একটা ইউজ করার শার্ট নিয়ে এসেছিলাম। যখনই মন পুড়তো প্রাণ কাঁদতো তখন বুকে জড়িয়ে তোমার ঘ্রাণ নিতাম। কাক্সিক্ষত প্রাণের মানুষটাকে কেড়ে নিয়ে গেল অন্য জনে। আমি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাই। দুর্মর অস্বস্তি শুষ্ক মরুভূমির মতো নিজেকে নির্জীব করে রেখেছি। ঘরের বউয়ের প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছিলে, আর পরনারীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে অনেক কিছুই করেছো। তার বিনিময়ে কি পেলে তুমি? তুমি আজ সত্যি করে বলতো আমায় অমানবিক কষ্ট দিয়ে তুমি কি খুব ভালো আছো? সুখী হতে পেরেছো? আমার খুব জানার ইচ্ছে ছিল তাই হয়তো আজ তোমার সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রোহান বলে সত্যি বলার মতো মুখ আমার নেই। তবে দাম্পত্য জীবনে আমি বড়ই অসুখী ভালো নেই পিউ, আমি ভালো নেই। মানুষ যখন মোহে পড়ে মরীচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ঘরের অমূল্য রতনকে ছাই মনে করে ঝেড়ে ফেলে দেয়, যখন হুঁশ ফিরে ততদিনে মরীচিকার আলো নিভে যায়, জীবনের সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মানুষের জীবনটাই বোধহয় এমন যা চাই তা পাই না, যা পাই তা চাই না। পিউ তোমাকে দেখার পর ভিতরটা খা খা শূন্যতার ঢেউ কেন উঠছে? আমি প্রচন্ড মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। আজ আমি বড়ই অসুখী, চরমভাবে অসুখী যদি পারো ক্ষমা করে দিও আমায়।
পিউ বলে তোমার ওপর আমার কোনো রাগ দুঃখ কষ্ট কিছুই নেই কারণ কি জানো? তুমি মূল্যহীন ভেবে যা ফেলে দিলে জারিফ সেটা মূল্য দিয়ে আজ আমায় কোথায় এনেছে দেখতেই পাচ্ছো। তোমার থেকে সরে গিয়ে জারিফকে পেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি জীবন কত সুন্দর, মানুষ কত মহান তোমার কাছে থাকলে এটা আমি কোনোদিনও জানতে পারতাম না। অনেকদিনের না বলা কথাগুলো বলতে পেরে পিউ আজ শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। পিউ হাতের ঘড়ি দেখে বলে, ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে উঠতে হবে এখন।
প্রেমে অন্য প্রান্তে
শীর্ষ সংবাদ: