ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১

জাতীয় জাগরণের যাত্রিক কবি

নীহার মোশারফ

প্রকাশিত: ১৯:১০, ৯ জানুয়ারি ২০২৫

জাতীয় জাগরণের যাত্রিক কবি

অবিভক্ত বাংলার কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ কবি মোজাম্মেল হক। মেঘনা-তেঁতুলিয়া বিধৌত পলিমাটির দেশ ভোলার এক বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই লালিত এবং বিকশিত হয়েছিলেন তিনি। মোজাম্মেল হক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগঠক, সমাজসেবক, রাজনীতিক ও  পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। দ্বীপজেলা ভোলায় বেড়ে উঠলেও পুরো উপমহাদেশ জুড়েই তাঁর খ্যাতি ছিল। যখন আমাদের দেশে শিক্ষা এবং সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল সাধারণ মানুষ তখন তিনি তাদের জাগিয়ে তোলার জন্য গেয়ে উঠলেনÑ ‘নির্জীব বাঙালি তোরা কে দেখিবি আয়’। শুধু কবিতাই নয়, শিক্ষা বিস্তারের জন্যও তিনি সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন মানুষের কল্যাণে। বাংলা সাহিত্যে একজন কবির বিরল দৃষ্টান্ত এই যে, তিনি শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার হওয়ার পাশাপাশি প্রায় ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তাঁর সময়েও আধুনিক ছিলেন। সমকালে প্রগতির প্রেক্ষাপটেও অনেক কবি-সাহিত্যিকদের রক্ষণশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ কবি মোজাম্মেল হক ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী প্রেরণা। মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের প্রথম সংগঠন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ ও পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সম্পাদিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় কবি নজরুলের প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ এবং গল্প ‘হেনা’ প্রকাশ পায়। মোজাম্মেল হকের আমন্ত্রণে কবি নজরুল করাচির সৈনিক জীবন ছেড়ে পুরোদমে সাহিত্যে মনোনিবেশ করেছিলেন। মোজাম্মেল হক সেই সময় কলকাতায় ‘দি ওরিয়েন্টাল প্রেস অ্যান্ড পাবলিশাস’ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের বহু গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
১৯০০ সালের দিকে কবি’র নামের সঙ্গে মিলে যাওয়া তৎকালীন নদীয়ার শান্তিপুরের প্রধান মুসলিম কবি মুন্সী মোজাম্মেল হক বাংলা ১৩০৭ সালের বৈশাখ মাস হতে লহরি নামে একটি কবিতার কাগজ বের করতেন। বার্ষিক মূল্য ছিল এক টাকা। সেখানে জাতীয় মঙ্গলের কবি’র ‘অভাগা-বিলাপ’, ‘নববর্ষ’, ‘পথহারা পান্থ’ ও সান্ত্বনা শীর্ষক ৫টি কবিতা ছাপা হয়। সম্পাদক ‘অভাগা-বিলাপ’ কবিতা পড়ে মন্তব্য করেন, ‘অভাগার এই বিলাপ’ নিরতিশয় মর্মস্পর্শী। ইহা পাঠ করিলে হৃদয় শোকে ও ক্ষোভে অবসন্ন হইয়া পড়ে। এই কবিতা পড়ে মালদহ-কানসাটের জমিদার মৌলবী মোহাম্মদ এয়াকুব আলি চৌধুরী জাতীয় মঙ্গলের কবিকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চেয়েছিলেন।
কবি মোজাম্মেল হক ১৮৮৩ সালের ৫  সেপ্টেম্বর ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা গ্রামে পরাণ তালুকদার বাড়ির মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী আব্দুল করিম। মাতা বিবি আরফিনজান বেগম। তিনি ১৯০১ সালে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। ভোলা জেলার তৃতীয় গ্র্যাজুয়েট তিনি। আদালতে জজ বা বিচারককে ‘মাই লর্ড’ বললে শিরক হবে ভেবে এলএলবি পাস করে অ্যাডভোকেট হয়েও আইন পেশা ত্যাগ করেন।
তিনি কলেজে পড়া অবস্থায়ই মুসলমান সমাজের হৃত গৌরব ও আত্মবিশ^াস ফিরিয়ে আনার জন্য জাতীয় মঙ্গল কাব্য রচনায় হাত দেন। তাঁর প্রথম কবিতাগুলো ছাপা হয় মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত সাপ্তাহিক সোলতান, মুন্সী রেয়াজ উদ্দিনের ইসলাম প্রচার ও মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’তে। কমরেড মুজাফফ্র আহমদ কবি মোজাম্মেল হক সম্পর্কে তাঁর স্মৃতি কথায় বলেন, কবি মোজাম্মেল হকের সময় ছিল বড় কম। তিনি একই সঙ্গে আইন ও এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথমে বেকার হোস্টেলের অ্যাসিসটেন্ট সুপারিনটেনডেন্ট ও পরে কারমাইকেল হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছিলেন। তার ওপরে তিনি ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও নিয়েছিলেন। বিশিষ্ট কূটনীতিক ও সাহিত্যিক সৈয়দ আবদুস সুলতান তাঁর এক নিবন্ধে লিখেন, কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক হাজার সদস্যের মধ্যে মাত্র নয়জন ছিল মুসলমান। তখন কবি মোজাম্মেল হক চিন্তা করে স্থির করেন অনুরূপ একটি সাহিত্য সংগঠনের মাধ্যমে সকল মুসলমান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের একত্রিত করে সমাজের অগ্রগতি সাধনে ব্রতী হবেন।
মুসলমান কবিদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা হবে কী, তাদের পড়ালেখা ও জানার আগ্রহই ছিল কম। মুসলিম পরিবারের ছেলেদের বয়স ১০-১২ বছর হয়ে গেলেও বাবা-মা স্কুলে ভর্তি করতে চাইতেন না। ছেলেরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াত। মেয়েদের পড়ালেখার বিষয়টি তো ভাবাই যেত না। সমাজের এই অসহনীয় অবস্থা দেখে কবি জাতীয় মঙ্গল কাব্যের ‘নির্জীব বাঙালি’ কবিতায় লিখেছেনÑ
দশ বর্ষ যায় চলে,
তবুও ‘দুধের ছেলে’
কি জানি ‘আলোক’ দেখে পাছে ভয় পায়,
নির্জীব বাঙালি তোরা কে দেখিবি আয়,
বারবর্ষ বয়স হলে,
গিয়া গ্রাম্য পাঠশালে,
‘বানান’ শিখিতে দু’টি বর্ষ চলে যায়
নির্জীব বাঙালি তোরা কে দেখিবি আয়।
মোজাম্মেল হক বলেন, সেই সুদূর একশত কি সত্তয়া’শ বৎসর পূর্বেই ভোলা মহকুমার বর্তমানের ন্যায় কোনো ‘সিনেয়র কিম্বা জুনিয়র’ মাদ্রাসা ছিল না। শুধু ধর্মশিক্ষার জন্য কোরআন খতমের পাশাপাশি পান্দেনামা, গোলেস্তাঁ ও বোস্তাঁ পড়ান হতো। গোলেস্তাঁ ও বোস্তাঁ পাঠান্তে কেহ কেহ পারসি ইউসুফ-জোলায়খাঁ, সেকন্দরনামা, শাহনামা প্রভৃতি কেতাব পড়িতেন।
মোজাম্মেল হক সে সময় বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনা করতেন। তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে খানের শ^শুর আবদুল বারী চৌধুরী, হাবিবুল্লা বাহার, নুরুল হক চৌধুরীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকতেন।
মোজাম্মেল হক বলেন, বর্তমানে যেরূপ বৎসর বৎসর নূতন পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত হয়, পূর্বে সেরূপ ছিল না। জানিয়াছি বাল্যশিক্ষা তিন পুরুষ পর্যন্ত পাঠ্য ছিল। তারপর তৎকালীন বহুল প্রচলিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত শিশুশিক্ষা। তারপর ছিল পণ্ডিত ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত প্রসিদ্ধ পাঠ্যপুস্তক বোধোদয়। এই সময় শ্রী মনোমোহন বসু প্রণীত কোমল-কবিতা নামে একখানা অতি সহজ-সরল, অনিন্দ্যসুন্দর এবং সুললিত কবিতা পুস্তক আমাদের পাঠ্য ছিল। এ পুস্তকের ‘রেলগাড়ি’, ‘আম’, ‘পেয়ারা’ ‘টিয়া পাখি’ প্রভৃতি সুললিত কবিতাগুলি পড়িয়া আমার ভিতরের সুপ্ত কবিত্ব শক্তি জাগরিত হইয়া উঠিল। তাহার কিছু নমুনাÑ

ধুপ ধাপ ধুপ ধাপ গড় গড় রবে,
শিকলে বাঁধিয়া সারি,
চলেছে রেলের গাড়ি,
দূরে থাকি দু’কাতারে দেখিতেছে সবে।
(রেলগাড়ি)

অমৃত স্বর্গেতে থাকে লোকে এই বলে,
তাত নয় আমাদের আমগাছে ফলে।
(আম)

টিয়া পাখি টিয়া পাখি কোথা তুমি যাও,
গাছে গাছে উড়ে উড়ে মিষ্ট ফল খাও।
(টিয়া পাখি)

পেয়ারা হে কি গুণ তোমার,
কাচা খাই ডাসা খাই,
পাকার’ত কথা নাই
সব তাতে তৃপ্তি রসনা
(পেয়ারা)    

অনেক আগ থেকেই যখন ভোলা জেলার মর্যাদা পায়নি তখন থেকেই ভোলা মহকুমার মুসলমান-সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ছিল না। সিপাহি-বিদ্রোহের মন্ত্রদাতা সন্দেহে ইংরেজরা মুসলমানদের গাছে লটকিয়ে গুলি করে হত্যা করত। এতে তৎকালীন মুসলমানগণ ইংরেজি তরক বা বর্জন করল। আর বাঙ্গালার একছত্র মুসলিম নেতা নওয়াব আব্দুল লতিফ দূরদৃষ্টি দ্বারা বুঝতে পারলেন, মুসলমানগণ ইংরেজি শিক্ষা ত্যাগ করলে তারা অধঃপতনের শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছতে সময় লাগবে না। ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া মুসলমানদের মুক্তি নেই। সেজন্য তিনি মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। চেষ্টা করেছেন মুসলিম রেনেসাঁ ও জাতীয় মঙ্গলের কবি মোজাম্মেল হক।
কবি মোজাম্মেল হকের ব্যক্তি মাধুর্যে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছিল পুরো বাংলাজুড়ে। তিনি দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন, সৌম্যকান্তি, সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। সবসময় শাদা ধবধবে পায়জামা ও পানঞ্জাবি পরতেন। কবি দরিদ্র ও আত্মীয়স্বজনদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তিনি ও বরিশালের এ কে ফজলুল হক বাঙালি সমাজ ও সভ্যতার প্রবাদপুরুষ ছিলেন। মোজাম্মেল হক যখন কৃষক প্রজা পার্টির চিফ হুইপ তখন ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী যখন বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনে সরকারি ট্যুরে যেতেন তখন মন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত সেলুন কারে শুধু কবি মোজাম্মেল হকের জায়গা হতো। শেরেবাংলার সহকর্মী এমএলএ ছিলেন তিনি। এমনি ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিক বন্ধুত্ব। দুজনের মিশন, ভিশন, কর্মপ্রচেষ্টা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল এক। মানবতার জয়গান, মানবাধিকার রক্ষা এবং উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠায় তাদের কর্ম বাঙালির হৃদয়ে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে।
কবি বাংলার মুসলিম সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের সংগঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ‘করিম বক্স ব্রাদার্স’ নামক বাইন্ডিংখানার মালিক মোঃ আবদুর রহমানের বিস্তৃত বাড়ির উঠোনে সভা ডেকেছিলেন তিনি। ডাকযোগে লেখক ও সাংবাদিকদের ঠিকানায় ঠিকানায় এক পয়সার পোস্টকার্ডে চিঠির মতো করে লিখে পাঠিয়ে পাঠিয়ে দাওয়াত জানিয়েছিলেন। সভায় যারা যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে দি মুসলমান সম্পাদক মৌঃ মজিবর রহমান, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও আল ইসলাম সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁ, ইসলাম প্রচার সম্পাদক মুন্সী রেয়াজউদ্দিন, মিহির ও সুধাকর সম্পাদক মুন্সী আবদুর রহিম, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইন্সপেক্টর মৌঃ আবদুল করিম, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, কুষ্টিয়ার মৌঃ আবদুল কুদ্দুস রুমী, চুয়াডাঙ্গা হাইস্কুলের হেড মৌলভী জনাব আফসার উদ্দিন আহমদ, সাহিত্যিক মোঃ এয়াকুব আলী চৌধুরী, বশির হাটের উকিল ড. মোঃ শহীদুল্লাহ ও মৌঃ আব্দুর রহমানসহ অনেকে। সেখানে প্রতি রবিবার নিয়মিত সাহিত্য বৈঠক বসত। জাতীয় মঙ্গল কবি মোজাম্মেল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় জাতীয় মঙ্গল কাব্য রচনা করে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম জাগরণের ঝংকার তুলেছিলেন। ১৯৩৪ সালে এই গ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণ বের হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ কবি মোজাম্মেল হকের জাতীয় মঙ্গল গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেন,  সেকালে আমাদের কাছে জাতীয় মঙ্গলে’র কবিতার বইখানা ছিল বাইবেলসদৃশ। তাঁর সম্পর্কে পল্লিকবি জসীমউদ্দীন লিখেছেনÑ

বয়স বৃদ্ধ মহাবট তরু
জীবন্ত ইতিহাস।
শাখায় শাখায় লিখিত রয়েছে
দিবস বয়স মাস।
আজ তমসা ঘোর, নিশাকালে
আজানের ধ্বনি লিয়ে,
তোমরা উদিলে জাতির আকাশে
রঙ্গীন উষশী নিয়ে।

কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, যে কালে এই মহামানবরা সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করেছিলেন তখন আমাদের সাহিত্য বলতে তেমন কিছু ছিল না। প্রথম দিকে তাঁরা সাহিত্য বৃক্ষের একটি চারা রোপণ করেছিলেন। আজ তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
মোজাম্মেল হক তরুণ বয়সেই পশ্চাৎপদ সমাজজীবনে গতি আনয়ন ও উন্নয়নে বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য  (এরপর ১১ পৃষ্ঠায়)
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। শুধু কাব্য রচনায় ব্যস্ত না থেকে কবি-সাহিত্যিক তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় মনোযোগ দেন। মুসলিমদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ধর্নাঢ্য ছিলেন। তাঁর বাড়িতে দৈনিক ৫০-৫২জন লোক তিনবেলা নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করত। তাদের সঙ্গেই কবি খাবার খেতেন। কবির বাৎসরিক আয়ের অধিকাংশই ব্যয় হতো সমাজকল্যাণমূলক কাজ ও দান-খয়রাতে। তিনি দুস্থ মানবতার খেদমতের জন্য ‘খাদেমুল ইসলাম সমিতি’ গঠন করেন। দুস্থদের জন্য সবসময় তাঁর মন আকুলিবিকুলি করত। তিনি ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদে জমিদার ও মহাজনী অত্যাচার-শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুসলমান ছাত্র সমিতি’। আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন পাকাপোক্ত। তাঁর  সম্পর্কে কবি আবদুল কাদির বলেন, আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ের লোক, কিন্তু দ্বিতীয় লাইনের নন। বাংলা ১৩১৮ সালে চট্টগ্রামে মওলানা আকরম খাঁ’র সভাপতিত্বে যে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল তাতে সভাপতির ভাষণের শেষ আটটি লাইন ছিল কবি মোজাম্মেল হকের কবিতা। কবি শুধু মুসলমানদের জন্য সাহিত্য সংগঠনই করেননি বরং তিনি কবি-সাহিত্যিকদের আর্থিকভাবেও সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এ প্রসঙ্গে কবি আবুল হোসেন বলেন, আমরা ছাত্র অবস্থায় যখন তাঁর কাছে যেতাম তিনি তখন আইন পরিষদের সদস্য এবং সাহিত্য সমিতির মধ্যমণি ছিলেন। যখনই আমাদের টাকা-পয়সার দরকার হতো আমরা তাঁর কাছে দৌড়ে যেতাম এবং তিনি কখনো আমাদের বিমুখ করতেন না।
সেসময় মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের ভরসার নাম ছিল কবি মোজাম্মেল হক। লেখালেখির তাগিদ দিয়ে, আর্থিক ও মানসিক সাহায্য করে, বই প্রকাশ করে লেখকদের জাগিয়ে তুলেছিলেন। কবি তালিম হোসেন বলেন,  সেকালে তিনি যদি সাহিত্যক্ষেত্রে এসব অবদান না রাখতেন তাহলে আজ আমরা যেখানে আছি সেখানে আসতে পারতাম কিনা সন্দেহ ছিল।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে কবি মোজাম্মেল হকের খুব শখ্য ছিল। দুজনে মিলেমিশে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি পত্রিকা’ সম্পাদনা  করেছেন। সমাজের অবহেলিত মানুষদের উন্নতির জন্য কবি আজীবন তাদের পাশে থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য কী সমাজসেবা কোনো ক্ষেত্রেই কারো সঙ্গে দলাদলি বা হিংসা করেননি।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের লেখার সংখ্যা কম, তবে এই ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’ বা অন্যান্য অবদান তাঁর বিরাট। মোজাম্মেল হক লেখক তৈরি করেছেন অনায়াসে। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও কর্মে এগিয়ে যাবে। ব্রিটিশদের অধীনে থেকে মনের দিক থেকে হিন্দু-মুসলিমদের দ্বন্দ্ব যেন না থাকে। মোজাম্মেল হক সম্পাদিত কাগজে সে সময় কবি গোলাম মোস্তফা, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, ডাক্তার লুৎফর রহমান, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, শাহাদৎ হোসেন, আবুল মনসুর আহমদসহ অনেক কবি লিখেছেন।
বঙ্কিম, রবীন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের সাহিত্য প্রতাপের সামনে বাংলার মুসলমানদের সাহিত্যকর্ম ও প্রয়াস যখন পিছিয়ে ছিল ঠিক সে সময় মুসলমান লেখকদের স্বকীয় চিন্তা ও প্রতিভা বিকাশের স্বার্থে ভোলার কবি মোজাম্মেল হক ছিলেন অন্যতম। তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল সুদূর কলকাতা থেকে ভোলা জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি ছিলেন সমাজের শত্রুদের ত্রাস ও পরাধীন নির্জীব মানবতার ঘুম জাগানিয়া বাঁশি। দক্ষিণ বাংলাসহ ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর মোজাম্মেল হক দীর্ঘদিন ভোলা সদরের গাজীপুর রোডের হালিমা মঞ্জিলে ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৬ সালের পয়লা আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

তথ্য নির্দেশ
০১.    মোস্তফা হারুণ, পলিমাটির দেশ ভোলা, শৌখিন প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, মে ২০০০, ঢাকা
০২.    প্রফেসর মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী, ভোলা জেলার ইতিহাস, বাংলাদেশ বুক ডিপো, প্রথম প্রকাশ, মার্চ ২০০১, ভোলা
০৩.    সিরাজ উদ্দীন আহ্মেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ভাস্কর প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ৩১ জুলই ২০০৩, ঢাকা
০৪. জিয়াউল কুদ্দুস, সংকলক, তিন পুরুষের গল্প, আপন আলো প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১, চট্টগ্রাম
০৫. মুহাম্মদ শওকাত হোসেন, ভোলা জেলার ইতিহাস, আজকের ভোলা ফাউন্ডেশন থেকে প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০২১
০৬. মুহাম্মদ শওকাত হোসেন, দৈনিক আজকের ভোলা স্মারকসংখ্যা, প্রথম প্রকাশ, জুন ২০১৫, ভোলা
০৭. কায়সার আহমেদ দুলাল, পথের পাণ্ডুলিপি, মাধুর্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, ১৭ সেপ্টেম্বের, ২০২১, ঢাকা
০৮. আযাদ আলাউদ্দিন, সম্পাদক, দ্বিমাসিক মুক্তবলি, জুলাই-আগস্ট সংখ্যা, ২০২১, বরিশাল
০৯. উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা

২১৭ কালিবাড়ি রোড, বাগানবাড়ি
ভোলা সদর, ভোলা
০১৭১৯২৫৯৪৬৩

×