ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

প্রকৃতির কুঞ্জবনে

আতাতুর্ক কামাল পাশা

প্রকাশিত: ২০:০৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২০:৩২, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রকৃতির কুঞ্জবনে

শাহ মতিন টিপুর কবিতা যতই পড়ি ততই যেন, ওই মদনমোহন তর্কালংকারের ‘ডুব দাও খুব খাও’-এর মতো পুলকবোধ করি। তবে সে কথা পরে, আগে দেখা যাক কবি শাহ মতিন টিপু জল জোছনার গান কেন নামকরণ করলেন? এর আগে তাঁর একক সংহিতার আর একটি বই প্রকাশ হয়েছিল যার নামটি ছিল ‘ছায়া ও ঘুণপোকা’। বর্তমান বইটি অনেক আগে পেয়েছি, কিন্তু অনেকদিন আপিসে যাবার পথে আর ফেরবার পথে নিজেকে প্রশ্ন করেছি, জল জোছনার গান নামটি কেন দিলেন! হঠাৎ একদিন রাতে মনে পড়ল, তিনি জাহাজে তাঁর বাড়ি ভোলায় মাঝে মধ্যে যেতেন, জাহাজে বসা অবস্থায় সেলে কথা হতো, কোথায়? জাহাজে। কি করছেন, পাশা ভাই জাহাজের ছাদে বসে মোবাইলে গেম খেলছি। কী বলব পাশাভাই, ওপরে চাঁদ আর নিচে পানি। পানির ওপর জাহাজ চলছে। পানিগুলো সোনালি রঙে ডুবে গেছে। সেরাম লাগছে পাশাভাই! আজ মনে হচ্ছে, সে রকম একটি মনোজাগতিক চেতনায় হয়ত বইটির জল জোছনার গান নামকরণ করেছেন কবি।
শুরু করেছিলাম ডুব দাও, খুব খাও দিয়ে। আমি তাঁর কবিতার দীর্ঘ পাঠক। সেই যে বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে তাঁর কবিতা পড়ে আসছি, আজো একইরকম কাব্যময়তার স্বাদ পাচ্ছি। তাঁর কবিতার অন্যতম গুণ ‘কাব্যময়তা’ ফেসবুকেই হোক বা জাতীয় দৈনিকগুলোতেই প্রকাশিত হোক, সব কবিতায় সব সময় উপস্থিত থাকে। তাঁর কবিতা সাবলীলভাবে পড়ে যাওয়া যায়। তবে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেভাবে তাঁদের কবিতাতে ক্রমেই এবং বয়সকালে আরও গম্ভীর হয়ে এসেছেন, শাহ মতিন টিপু ঠিক তেমনভাবে এখনকার কবিতাগুলোকে বেশ জাগতিকের পাশাপাশি এক আধ্যাত্ম আবহের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, এ কারণেই বলেছিলাম ‘ডুব দাও, খুব খাও’ প্রণিধানযোগ্য বচনটি। এটি একটি কবির সামাজিক দায়বোধও।
‘এইতো চলছে ছকে বাঁধা জীবন। সবার মতোই/ আমিও আটকে আছি আবর্তে। প্রত্যুষে গৃহত্যাগ আর/ সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখি খেলা করে আঁখিতে আমার। আমি আর পাখি, পাখি আর আমি, খুবই মাখামাখি। ... হোক ফাঁদ, হোক অপবাদ, লয়-ক্ষয় যা হয় হোক/ সব মেনেই- এ চিড়িয়াখানাই আমার প্রিয় অমৃতলোক।’ (অমৃতলোকের জীবন-পৃ-৯)। এটি সাধারণ অথচ একটি বিশাল বিশ^পাঠশালা মানবজগতের, তা কোনো মানবই অস্বীকার করতে পারে না। ‘শহরে থাকবে আর ঠান্ডা মেশিন উপভোগ করবে না/ মোটেও হয় কি তা, তবে তো ভালো সে গ্রামেরই শীতল ছায়া।/ চারদিকে এতো ফুল চোখ ধাঁধানো, এতো মদিরার ছড়াছড়ি-/ যদি না ছুঁয়েই দ্যাখো এই রূপরসে মাতানো মাতাল বিভাবরী/’ (শহর কাব্য-পৃ-১১)।
শাহ মতিন টিপুর কবিতার আর এক উপলব্ধি, ‘বললেন জওহরলাল নেহেরু, ‘মহেঞ্জোদারোর ওই টিলার ওপর দাঁড়িয়ে/ অনুভব করেছিলাম- আমি পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি/ পুরনো এক সভ্যতার উত্তরাধিকারী।’ (ঐতিহ্যের গান-পৃ-২৮)। এ কবিতাতেই কবির সহজ ও শাশ^ত বিশ^াস উঠে আসে, পাক-ভারত-বাংলা মুল্লুক উপমানচিত্রের একক সভ্যতার ঐতিহাসিক মূল্যবোধ।
তবে শব্দ সঞ্চয়ন ও দৃশ্যকল্প নির্বাচনে কবি বেশ প্রকৃতিপ্রেমী. পুরোপুরি বাঙালিআনায় সিক্ত। ‘এক চিলতে মেঘ হয়ে উড়ছিল দুটি চিল’ (পৃ-৪৬), ‘পাহাড়চূড়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘদূতকে দেখেছি/ মেতে উঠতে জীবনসংগীতে- (পৃ-৫০), ‘ভোরের সোনার থালা এখন ঊর্ধ্বগগণে’ (পৃ-৫১), ‘সেই পঁচানো পাট তার আশতোলা হরমুল/ সেই ছাতিমতলা ঝরে পড়া গাব কিংবা সেই/ কাঠবাদাম কুড়ানোর দিন কেনো এতো অমলিন’ (পৃ-৫৫)- এমন ধরনের প্রকৃতিসঞ্জাত শব্দমালা ও প্রকৃতি-সন্বিষ্ট দৃশ্যকল্প বেশ প্রাণবন্ত।
শাহ মতিন টিপু আশি দশকের শেষপ্রান্তের কবি। তাঁর কবিতা সহজেই আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। কাব্যে তিনি মৃন্ময়ী। তিনি বিশ^াস করেন, ‘বারবার মনে হয় আমিই অত্রিজাত/ এ আমারই অভিরূপ, নয় অভিন্ন-অজ্ঞাত।’ (পৃ-৬৪), প্রাচীন ঋগবেদের সপ্তঋষির অন্যতম ঋষি তিনি। সামনের দিনগুলোতে তিনি আরও নক্ষত্রমালা কুড়িয়ে এনে বারকেশজুড়ে আমাদের উপহার দেবেন, এ কাম্য আমাদের।
পরিপাটি মুদ্রণ। তবে প্রচ্ছদটিতে দেশের প্রখ্যাত কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম অনুসরণ উঁকি দেয়।
জল জোছনার গান/ শাহ মতিন টিপু। প্রকাশক/ চন্দ্রছাপ, আদাবর, ঢাকা। প্রকাশকাল/ একুশে বইমেলা, ২০২৪। প্রচ্ছদ/ মজনু বিশদ। মূল্য/ ২৮০ টাকা।  

×