ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

যুদ্ধের কবিতায় কবি-যোদ্ধা

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

যুদ্ধের কবিতায় কবি-যোদ্ধা

উনিশশো সত্তর সালের চৌদ্দই আগস্ট ছিল পূর্ববঙ্গসহ পাকিস্তানের শেষ স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটি উপলক্ষে মুলতানের উর্দু কবি রিয়াজ আনোয়ারের লেখা ‘আজাদির দিনে’ নামে একটি কবিতা তর্জমার ছলে সেদিন জসীমউদ্দীন প্রকাশ করেছিলেন নিজের মনেরই গহীনের বেদনা। তিনি তরজমায় বলেছিলেন-
‘আজ আজাদির তেইশ বছরে কিবা উন্নতি দেশে
নয়া সড়কের শত তন্তুতে আকাশের কোণ মেশে।
শোষণের আর শাসনের যেন পাতিয়া এই পথ-জাল
অন্তরীক্ষে আছে পাহারায় মহাশয় মহীপাল।
আজি আজাদির এ পুতঃ দিবসে বার বার মনে হয়
এই সুন্দর শ্যাম মনোহরা এ দেশ আমার নয়।’
একাত্তরের সূচনা থেকেই কবিরা নিয়ে বসে আছেন শব্দের প্রতিরোধ-অস্ত্র। একাত্তরের ষোল মার্চ কবি জসীমউদ্দীন ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ নামের কাব্যসংকলনভুক্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় লিখেছেন,
‘তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন ত্রাসন ভয়,
আমরা বাঙালী মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।’

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিজয়ের কবিতা
উনিশশো বাহাত্তরে আমরা বিজয়ের কবিতা পাই কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এর কাছে। এই কবিতার মূলভাব উনসত্তরকে ধারণ করলেও কবিতা সমাপ্ত হয়েছে মহান একাত্তরকে কেন্দ্র করে। কবি নিজেই বলেছেন তাঁর ‘শহীদ স্মরণে’ কবিতায়,
‘শহীদের পুণ্য রক্তে সাত কোটি
বাঙালির প্রাণের আবেগ আজ
পুষ্পিত সৌরভ।...
প্রাণময় মহৎ কবিতা
আর কোথাও দেখি না এর চেয়ে।’
কবি নির্মলেন্দু গুণের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা শব্দটি কী করে আমাদের হল’ আমাদের বিজয়কে পূর্ণাঙ্গভাবে মেলে ধরে বিশ্বের তাবৎ মানুষের কাছে। পাশাপাশি তার লেখা ‘স্বাধীনতা এক উলঙ্গ কিশোর’, তারই বন্ধু কবি আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ কবিতা দুটি বিজয়ের করুণ ও কষ্টকর অভিযাত্রা।
অনেকেই বিজয় আর মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লিখলেও সংগ্রামী একাত্তরে কবি জসীমউদ্দীন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লিখেছিলেন-
‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে,
ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে।’
কবি তার প্রতিবেশীনী গীতাদের পরিবারের করুণ পরিণতির কথা ভেবে ‘দগ্ধগ্রাম’ কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল চিত্রকে। কবি আবুল হোসেন ‘পুত্রদের প্রতি’ কবিতায়, কবি আহসান হাবীব ‘আমার সন্তান’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের অনির্বাণ আবেদনকে চিত্রিত করে তুলেছেন পরিপূর্ণ আবেগে। মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মসূত্রে লন্ডনে অবস্থান করলেও পরবর্তীতে কবি সৈয়দ হক অবয়বধর্মী কবিতা ‘গেরিলা’ কিংবা ‘বেজান শহরের জন্যে কোরাস’ এবং ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়কে তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে।
এছাড়া পঞ্চাশ দশকের কবিরা সরাসরি যুদ্ধে না গেলেও ‘স্মৃতি’ কবিতার মাধ্যমে হাসান হাফিজুর রহমান, ‘আর কত রক্ত দিতে হবে’ কবিতার মাধ্যমে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্, ‘আরো একবার ভালোবেসে’ কবিতার মাধ্যমে সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, ‘মা’ কবিতায় আতাউর রহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তার ‘জার্নাল ১৯৭১’ কবিতায়, সন্তোষগুপ্ত ‘ফেরারি স্বদেশ’ কবিতায়, কবি আহমদ রফিক ‘এ দেশ আমার স্বর্গ’ কবিতায়, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ‘ছবি’ কবিতায়, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ‘মঞ্চে দেখা দাও’ কবিতায়, আলাউদ্দিন আল-আজাদ ‘স্বাধীনতা ওগো স্বাধীনতা’ কবিতায় সরব হয়ে উঠেছেন মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী ধারণ করে। কবি শহীদ কাদরী ‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’ কবিতায় খুব চমৎকারভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। তার কবিতায় আমরা স্বাধীনতা ও বিজয়কে আজও জীবন্ত দেখতে পাই-
‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক...
ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ
ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো
এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই
প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা
অক্ষর
‘স্বা-ধী-ন-তা’।’
কবি সিকান্দার আবু জাফর সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন বাঙালির বিজয় নিয়ে। নিরন্তর তিনি পাকিস্তানীদের বাংলা ছাড়তে দাবি জানিয়ে বলেছেন,
‘তুমি আমার জলস্থলের
মাদুর থেকে নামো
তুমি বাংলা ছাড়ো।’(বাংলা ছাড়ো)
ভাষাবিজ্ঞানী কবি হুমায়ুন আজাদ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ কাব্যগ্রন্থের ‘খোকনের সানগ্লাস’ কবিতায় বিজয় প্রাপ্তির  পেছনে করুণ ত্যাগের কথা তুলে ধরেছেন পরম মমতায়-
‘... সারা বাংলা রক্তে গেছে ভিজে
যে নদীতে ভাসতো রাজহাঁস সেখানে ভাসছে শুধু নিরীহ বাঙালির লাশ।’
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার কবি ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা না লেখার অঙ্গীকার করেছেন যদি তিনি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম পতাকা পান। কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ যুদ্ধকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কন্সেট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেছেন কবিতায়। তিনি যখন বলেন-
‘তাঁর চোখ বাঁধা হলো
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তাঁর মুখ’-
তখন আমরা শিউরে উঠি সেই বীভৎসতায়। কবি মাহবুব সাদিক তার ‘যুদ্ধভাসান’ কবিতায় প্রত্যক্ষ যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন সখীপুরের সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করে। বিজয়ের কবিতা নিয়ে আরো অনেক কবিই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে শব্দশিল্পে অমর করে রেখেছেন।
আসাদ চৌধুরী ‘রিপোর্ট ৭১’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারীর ভূমিকাকে চমৎকার করে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বাঙালি নারীর প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির আলোকে। তার বদৌলতেই আমরা জানতে পারি-
‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
‘বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।...’

মুক্তিযোদ্ধা কবির বিজয়ের কবিতা
সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন ষাটের কবিদের অনেকেই। এমনই একজন কবি রফিক আজাদ যার কবিতা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বকে প্রস্ফুটিত করে তোলে-
‘হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা করলাম
বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে
ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুড়ে
টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালি স্বপ্নকে।’ (একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ)
মুক্তিযোদ্ধা কবি ভাস্কর চৌধুরীর কবিতায় আমরা পাই-
‘কে সম্মুখ যুদ্ধে প্রিয় সহযোদ্ধার
তাজা রক্তাপ্লুত লাশ দেখেছেন?
কে দেখেছেন বলুন?’
মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন কবি ফরহাদ মজহারও। যদিও আজ স্খলিত আদর্শ নিয়ে দিকভ্রান্ত তবুও একসময় সদ্য যুদ্ধফেরত কবি লিখেছিলেন-
‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো বিপ্লবের সামনে
আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছো ইতিহাসের সামনে
হাতে দিয়েছো স্টেনগান
আঙ্গুল ভর্তি ট্রিগার
এখন আমার আর ফেরার কোন পথ নেই...।’

ছোটদের কবিতায় বিজয়
ছোটদের কবিতায় বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধ প্রকট হয়েছে অনিন্দ্য আবেদনে। মুক্তিযুদ্ধে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা যেমন অংশ নিয়েছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধে শিশু ও কিশোররাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অসংখ্য যুদ্ধশিশুর জন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বর্বরতাকেই মনে করিয়ে দেয়। ছোটদের জন্যে ‘প্রিয় স্বাধীনতা’ কবিতায় কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতা ও বিজয়ের মধ্যে খুকুর চপল হাসিকে অবলোকন করে লেখেন-
‘স্বাধীনতা আমার মোহন-বাঁশি স্বাধীনতা
খুকুর চপল হাসি।’
ছোটদের আরেক কবি খালেক বিন জয়েনউদ্দিন প্রিয় স্বাধীনতা আর একাত্তরকে দেখেন পাখির ডানার পোস্টারের মতো। তাই ‘ভোরের পাখি’ কবিতায় কবি যেন ছোট্ট কিশোর হয়ে বলে উঠেন,
‘মনে আমার ঝলসে উঠে একাত্তরের কথা,
পাখির ডানায় লিখেছিলাম প্রিয় স্বাধীনতা।’
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শামসুর রাহমান আরো লিখেছেন-
‘যুদ্ধ এবার মুক্তিযুদ্ধ,
দিকে দিকে মুক্তি সেনা-
মাটি ছুঁয়ে নেয় যে শপথ
জন্মভূমির মান দেবে না।’

ছোটদের বন্ধু কবি আখতার হুসেন ছোটদের মুক্তিযুদ্ধ আর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের গুরুত্ব জানাতে লিখেছেন-
‘সোনামানিক ভাইরা আমার
সেই কবে কোন সনে
দানোর সাথে করতে লড়াই
গিয়েছিলেন রণে।’
(সোনামানিক ভাইরা আমার)
বিজয় নিয়ে ছোটদের আরো জানিয়েছেন সুকুমার বড়ুয়া যিনি মুক্তিসেনার ত্যাগের মহিমা তুলে ধরে ‘মুক্তিসেনা’ কবিতায় বলেন-
‘ধন্য ওরাই ধন্য
অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করে
মাতৃভূমির জন্য।’
ছোটদের আরেক কবি লুৎফর রহমান রিটনের কবিতায় উঠে আসে এক সাগর রক্তের কথা। তার কবিতা হতেই আমরা জানতে পারি-
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা শহিদ ছেলের দান
কে লিখেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার গান?
স্বাধীনতার গানগুলো লাল রক্তে হলো লেখা
রক্ত সাগর পেরিয়ে পেলাম স্বাধীনতার দেখা।’

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কবির কবিতা
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের। তারা একদিকে যেমন এককোটি শরণার্থীকে লালন-পালন করেছেন নয়মাস, তেমনি বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতেও ব্যস্ত ছিলেন। এর পাশাপাশি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় নিয়ে তারা অমূল্য কবিতাও রচনা করেছেন। কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা’ শিরোনামে লিখেছেন এক অসাধারণ কবিতা-
‘আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা ব’লেও নষ্ট কোরো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।’

পশ্চিবঙ্গের জয়ন্ত সাহা একাত্তর-বাহাত্তর সালে প্রকাশিত পশ্চিবঙ্গের পত্র-পত্রিকা ঘেটে পঞ্চাশ জন কবির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতা নিয়ে একটি অসাধারণ সংকলন সম্পাদনা করেন। কবিতাগুলোর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ব এক ভিন্ন চিত্র প্রতিফলিত হয়। এতে মনীশ ঘটক, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন বসু, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত, মনীন্দ্র রায় থেকে শুরু করে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সিদ্ধেশ্বর সেন, রানা বসু, শক্তি চট্টপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ কবির কবিতায় সমৃদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় নিয়ে পাকিস্তানি কবিদের কবিতা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বৈর শাসকদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ ছিল না। আমরা কেবল আমাদের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। আমাদের যৌক্তিক দাবিকে সম্মান জানিয়ে, আমাদের উপর অমানবিক নির্যাতনকে নিন্দা করে পাকিস্তানী কবিরাও লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন কবিতা। কবিতা লিখে জেল খেটেছেন কবি আহমেদ সালিম। সালিম ছাড়াও ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সৈয়দ আসিফ শাহাকার, আহমদ ফরাজ এদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন ও সমবেদনা ফুটে উঠেছে। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ লিখেন-
‘এই হত্যার উৎসব কী দিয়ে সাজাই?
কী দিয়ে রাঙাই এই হত্যাযজ্ঞ!’
সৈয়দ আসিফ শাহাকারের কবিতায় পাই-
‘বাংলা দেবী, এই স্বাধীনতার রয়েছে অনেক ঋণ
এই ঋণ শোধ হয়েছে
তোমার হাজারো সন্তানের শক্তি ও মুক্তি দিয়ে’।

অন্যান্য বিদেশী ভাষায় বিজয়ের কবিতা
বাংলা ভাষা ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্য ভাষার কবিরাও কবিতা রচনা করেছেন।
উনিশশো একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পাপুয়া নিউগিনি থেকে বিদেশী ও বাংলাদেশী কবিদের ইংরেজিতে ভাষান্তরিত একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের সমর্থন আদায়ে ‘টু ইচ মাই ব্লাড এ্যান্ড আদার হিম’ নামে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দেশটি থেকে এই কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যার সম্পাদক কবি পৃথেন্দ্র চক্রবর্তী। পৃথেন্দ্র চক্রবর্তী ও উলি বেয়ার বাংলা কবিতাগুলো ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভূমিকার বিরুদ্ধে কবিতায়-গানে-আলোকচিত্রে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন লিয়ার লেভিন, এ্যালেন গিন্সবার্গ, জর্জ হ্যারিসন, জোয়ান বায়েস প্রমুখ ব্যক্তিরা। জোয়ান বায়েসের গীতিকবিতা-
‘ইধহমষধফবংয, ইধহমষধফবংয
ডযবহ ঃযব ংঁহ ংরহশং রহ ঃযব বিংঃ
উরব ধ সরষষরড়হ ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ইধহমষধফবংয’ বিশ্বকে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশের নাম।
গিন্সবার্গের সেই অসাধারণ বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড ’ কিংবা হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ শীর্ষক কবিতা ও গীতিকবিতা আমাদের অমূল্য সম্পদ।
মার্কিন কবি এ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা আজও জ্বলজ্বল করে আমাদের মানসপটে-
‘গরষষরড়হং ড়ভ ভধঃযবৎং রহ ৎধরহ
গরষষরড়হং ড়ভ সড়ঃযবৎং রহ ঢ়ধরহ
গরষষরড়হং ড়ভ নৎড়ঃযবৎং রহ ড়িব
গরষষরড়হং ড়ভ ংরংঃবৎং হড়যিবৎব ঃড় মড়...’

ব্রিটেনের টমাস এ্যানসেল ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় লিখেছেন- ‘এই ভূমি অশ্রুতে ভেসে গেছে
আর অনাথের কান্নায় উচ্চকিত
মৃতের লাল রক্তে শহীদেরা মিশে আছে’। অস্ট্রেলিয়ান কবি ফিলিপ ভয়েজি বেদনায় কাতর হয়ে বলেন-
‘তোমার কী হবে বাংলাদেশ
গোটা পৃথিবী তোমার কান্না দেখেছে
মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো তোমার একটি টুকরো মৃত।’
সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের সঙ্গে যেমন আমাদের পতাকার অপূর্ব মিল আছে তেমনি মিল আছে মানসিকতারও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জাপান যে অবদান রেখেছে তা তাদের কবিতাতেই প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন-
‘বন্ধু, তোমাদের মায়ের ক্রন্দন ঝরছে বৃষ্টির জলে তোমাদের ভাইয়ের বেদনা বইছে নদী-ঝর্ণায়।’ বসনিয়ান কবি ইভিৎসা পিসেস্কি লিখেছেন-
‘আমি তখনো জন্ম নেইনি
তারপরও আমি তাদের দৃঢ়কণ্ঠের
আওয়াজ শুনেছি। জোরে জোরে বলছে : মুক্তি।’
মারাঠি কবি হিরা বানসোদের কবিতায় পাই-
‘যে সাহসে ভর করে পেয়েছ বরমাল্য
আমার বন্ধুরা, তোমাদের জন্য এনেছি সূর্যোদয়।’
নেপালি কবিদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতি ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। নেপালি কবি বিবশ পোখরেল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি যুগিয়ে বলেন-
‘শত্রুকে পরাজিত করে
উড়িয়ে দাও
সবার জন্য
একটি সমবেত সকাল।’

কালের ব্যাপ্তিতে নয়মাস খুব অল্প সময় হলেও এর ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতা বিশাল। তিরিশ লক্ষ শহীদ
আর দুই লক্ষ মা-বোনের সমভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া বিজয় পৃথিবীর নানা দেশে নানাবিধভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কারও কাছে গানে, কারও কাছে চিত্রে আবার কারও কাছে কবিতায় বিজয় হয়ে উঠেছে অর্থবহ। বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিগত সাতচল্লিশ বছর ধরে লিখা কবিতার হদিশ বের করা সত্যিই হার্কিউলিসের কাজ। এমনকি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যত বিজয়ের কবিতা রচিত হয়েছে তার হিসাব বের করাও সহজ নয়। সাহিত্যের স্রোতধারায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার বিজয় ঘটিয়েছে ব্যাপক সৃজনশীলতার উন্মেষ। এই সৃজনশীলতা দীর্ঘজীবী হোক, বিশ্বজয়ী হোক।

×